বন্ধ্যা—
নারীর সঙ্গে খুব সহজেই জুড়ে দেওয়া হয় এই বিশেষণ। অথচ বন্ধ্যত্বের সমস্যা কিন্তু
পুরুষেরও হতে পারে। মুশকিল এটাই, অনেক ক্ষেত্রেই দাগিয়ে দেওয়া হয় সঙ্গের
নারীটিকে। বড় হয়ে দেখা দেয় পৌরুষ,
সমাজে মুখ
দেখানোর ‘লজ্জা’। অসুখ চেপে রাখার ফলে ধীরে ধীরে হানা দেয় অবসাদ। অথচ, পুরুষের বন্ধ্যত্ব বা মেল ইনফার্টিলিটি একটি অসুখ। নিয়মিত চিকিৎসাতেই সারে
তা। ইউরোলজিস্ট ডা. অমিত ঘোষের কথায়,
“সমাজে
যৌনতা নিয়ে অস্বস্তি যত থাকবে, তত এই সমস্যাগুলি আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
যুগযুগান্ত ধরে নারী-পুরুষের সম্পর্কে পুরুষের বন্ধ্যত্ব একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়।”
কখন
বন্ধ্যত্ব চিহ্নিত করা হয়?
ডা. ঘোষ
জানালেন, এক বছর ধরে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক থাকা
সত্ত্বেও যদি সন্তানধারণ সম্ভব না হয়,
তবেই বলা
যায় বন্ধ্যত্ব। ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের অসুস্থতা,
২০-৩০
শতাংশ ক্ষেত্রে নারীর অসুস্থতা ও ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে দু’জনের অসুস্থতাই বন্ধ্যত্বের
কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পুরুষের
স্বাভাবিক প্রজনন মূলত দু’টি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। সুস্থ ও স্বাভাবিক শুক্রাণুর
উৎপাদন ও যথাযথ ভাবে পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হওয়া (ইরেকশন) এবং বীর্য ও শুক্রাণুর নির্গমন
(ইজ্যাকুলেশন) যাতে তা নারীদেহের ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্ত হতে পারে। যদি শুক্রাণুর
মান কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যায় অথবা শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু নির্গমনের পথ সুগম না
হয়, তখন বন্ধ্যত্ব আসতে পারে।
কী কী
কারণে দেখা দিতে পারে বন্ধ্যত্বের সমস্যা?
ডা. ঘোষ
বললেন, “অনেক সময়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষমতাও
বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। চিকিৎসকের পরিভাষায় একে বলে সেক্সুয়াল ডিসফাংশন। এ
ছাড়া থাকতে পারে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন,
অর্থাৎ
এতে পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হওয়ার সমস্যা ও ইজ্যাকুলেশনের সমস্যাও থাকতে পারে। এর জন্য
যৌনতা ও যৌনজীবন সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। তবেই সমস্যা হলে নির্দ্বিধায়
চিকিৎসকের কাছে আসতে পারবেন মানুষ।” এই ধারণা তৈরি করার জন্য বয়ঃসন্ধি থেকেই সেক্স
এডুকেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি তিনি এ-ও জানালেন, অনেকেই সম্পর্ক স্থাপনের সময়ে নানা ধরনের লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করেন।
এগুলি ব্যবহারের ফলে শুক্রাণু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ডা. ঘোষের কথায়, সংক্রমণ, হরমোন ও জিনগত সমস্যা, পরিবেশ ও জীবনশৈলীর কারণে পুরুষের বন্ধ্যত্ব দেখা যায়।
-
অসুখ ও সংক্রমণে: মূলত মাম্পস বা
ওই জাতীয় সংক্রামক জ্বরের ফলে যদি শুক্রাশয় ফুলে যায় সেখান থেকে শুক্রাণুর
ক্ষতি হয়। এর পাশাপাশি শুক্রাশয়ে যক্ষ্মা হলে ভাস ডেফারেনস (শুক্রনালি দিয়ে
শুক্রাশয় থেকে শুক্রাণু নির্গত হয়) রুদ্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া ডায়াবিটিস, ক্যানসার ইত্যাদি
কারণেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবে দেহের
অ্যান্টিবডি শুক্রাণুকে বিনষ্ট করে। শুক্রাণুর সংক্রমণ হলে তাঁর নড়াচড়ার
ক্ষমতা লোপ পায়। ফলে বন্ধ্যত্ব অবধারিত।
-
হরমোনের সমস্যায়: ডা. ঘোষ জানালেন, মূলত মস্তিষ্কের
পিটুইটারি হাইপোথ্যালামাস গোনাগল অ্যাক্সিসে সমস্যার কারণে পুরুষ প্রজননের
হরমোনগুলি যথাযথ ভাবে নিঃসৃত হয় না। সেখান থেকে শুক্রাণু উৎপাদন ও নিষেকের
বিষয়ে সমস্যা আসতে পারে।
-
জিনগত সমস্যায়: জিনগত সমস্যা
পুরুষ বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ। এই সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে ক্লাইনেফেল্টার
সিনড্রোম (যাতে ছেলেরা একটি অতিরিক্ত এক্স ক্রোমোজ়োম নিয়ে জন্মায়)। সিস্টিক
ফাইব্রোসিসের সমস্যায় অ্যাস্পার্মিয়া দেখা যায়। অনেক সময় শুক্রনালি তৈরিই হয়
না, একে
বলা হয় কনজেনিটাল অ্যাবসেন্স অব ভাস ডেফারেনস।
-
জন্মগত কারণে: অনেকেরই
শুক্রাশয়ের গঠন ঠিক হয় না। তলপেট থেকে নীচের দিকে পুরোপুরি ভাবে গঠিত হয় না
সেটি। এটিকে বলা হয় আনডিসেন্ডেড টেস্টিকুলার। পরে সেই শুক্রাশয় থেকে ক্যানসার
ও বন্ধ্যত্ব সংক্রান্ত নানা সমস্যা আসতে পারে। সুতরাং, পুত্রসন্তানের
জন্ম দিলে নতুন মায়েদের অবশ্যই ছেলেদের শুক্রাশয় পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
-
অস্ত্রোপচার ও আঘাতে: কিছু ক্ষেত্রে
অস্ত্রোপচারের সময় শুক্রনালিতে আঘাত লাগতে পারে। বিশেষত হার্নিয়া বা ওই জাতীয়
অস্ত্রোপচারের সময়ে। এ ছাড়া কোনও আঘাত লাগলে সেখান থেকেও সমস্যা দেখা যায়।
ডা. ঘোষ বললেন, “একটি
বিশেষ সমস্যার নাম ‘টরশন অব টেস্টিকল’। শুক্রাশয় নিলম্বিত অবস্থায় থাকে, অনেক সময়ে আঘাতের
কারণে সেটি সম্পূর্ণ ঘুরে যায় (টুইস্টেড)। এর ফলে অসম্ভব যন্ত্রণা হয়, শুক্রাশয় ফুলে
যায়। অস্ত্রোপচার ছাড়া এর চিকিৎসা নেই। শুক্রাশয়কে আবৃত করে রাখা
স্ক্রোটামের শিরা উপশিরা ফুলে গেলে হয় ভেরিকোসেল। এটি অনেকটা পায়ের ভেরিকোজ়
ভেন অসুখটির মতো।”
-
ওষুধ ও পেশাগত কারণে: শারীরচর্চার জন্য
বেশি মাত্রায় স্টেরয়েড ব্যবহার করলে, অতিরিক্ত অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট ও
অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ খেলেও বন্ধ্যত্বের সমস্যা আসে। এ ছাড়া অতিরিক্ত তাপ
ও রেডিয়েশনের সামনে থাকলে, মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান করলে, কর্মক্ষেত্রে বা
জীবনে ভীষণ ভাবে চাপের মধ্যে থাকলেও বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা যায়।
শুক্রাণুর
সমস্যা হলে চিকিৎসা শুরুর পর তা কার্যকর হতে প্রায় তিন মাস সময় লাগে। ন্যূনতম ২
কোটি শুক্রাণু না থাকলে সন্তান উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে।
-
অ্যাস্পার্মিয়া: ডা. ঘোষ জানালেন, ফাইব্রোসিসের
সমস্যায় অ্যাস্পার্মিয়া দেখা যায়। এতে পুরুষের অর্গাজ়ম হলেও তা থেকে কোনও
বীর্য (সিমেন) নির্গত হয় না।
-
হাইপোস্পার্মিয়া: এতে স্বাভাবিক
১.৫ মিলিলিটারের থেকে কম বীর্য নির্গত হয়।
-
অ্যাজ়ুস্পার্মিয়া: বীর্যে একেবারেই
শুক্রাণু থাকে না। ক্যানসার, জিনগত অসুখ, হরমোনজনিত, যৌন রোগ ইত্যাদির
কারণে এই সমস্যা দেখা যায়।
-
অলিগোজ়ুস্পার্মিয়া: বীর্যে শুক্রাণুর
আকার, গতি
অন্য রকম হয়। পরিমাণও খুব কম থাকে। মূলত সংক্রমণ, ভেরিকোসেল ভেন, হরমোনজনিত কারণে
এই সমস্যা দেখা যায়।
-
অ্যাসথেনোজ়ুস্পার্মিয়া: বীর্যের মধ্যে
বিপুল পরিমাণ শুক্রাণুর গতি অস্বাভাবিক হয়। কখনও একেবারেই কোনও গতি থাকে না।
এর সঙ্গে শুক্রাণু নষ্ট হতে থাকে।
-
অলিগোঅ্যাসথেনোজ়ুস্পার্মিয়া: বীর্যের মধ্যে
শুক্রাণুর আকার, গতি
ও গড়ন অস্বাভাবিক থাকে। শুক্রাণুর কাউন্ট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম হয়।
-
নেক্রোজ়ুস্পার্মিয়া: বীর্যে বেশির ভাগ
শুক্রাণু মৃত অবস্থায় থাকে।
চিকিৎসা
কী?
রোগ
নির্ণয়ে প্রয়োজন সিমেন ও ব্লাড টেস্ট,
আলট্রাসাউন্ড
ও প্রয়োজনে টেস্টিকুলার বায়প্সি। চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার ছাড়াও রয়েছে
ইন্ট্রা-ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন, ডোনার ইনসেমিনেশন, ইন্ট্রা-সাইটোপ্লাজ়মিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন,
টেস্টিকুলার
স্পার্ম অ্যাসপিরেশন। কোনটি প্রয়োজন তা চিকিৎসক বলবেন। বন্ধ্যত্ব একটি অসুখ, তা না লুকিয়ে এর চিকিৎসা প্রয়োজন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)