উঁচুতে উঠলেই প্রবল ভয়! ছবি: সংগৃহীত।
আদতে একটা আরশোলা, তাকে দেখেই বিষম ভয়। ছ’তলার উপর বারান্দা। তবে পড়ে যাওয়ার কোনও আশঙ্কাই নেই। তবু সেখানে দাঁড়ালেই, বুক ধড়ফড়ানি। যার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। অন্য অনেকের কাছে বিষয়টি হাস্যকর মনে হলেও, একেই বলে ফোবিয়া। চিকিৎসকদের কথায়, এটা হল, অমূলক আশঙ্কা বা অহেতুক ভয়, যা মনের উপরে চেপে বসে, সহজে তাড়ানো যায় না।
এই যেমন টিকটিকি। ছোট্ট একটি প্রাণী। কী-ই বা করতে পারে সে! তবু তাকে নিয়ে ভয়। সেই ভয় এতটাই যে, প্রাণীটিকে দেখলে কেউ জুড়ে দেন চিল-চিৎকার, কারও আবার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় এক ধাক্কায়। কারও ভয় অন্ধকারে, কারও আবার বদ্ধ জায়গায়। সেই তালিকাতেই জুড়ে যায় আর এক নাম, যাকে বলা হয় অ্যাক্রোফোবিয়া।
কী সেই ভয়?
ঘটনা ১ : বন্ধুদের সঙ্গে শিক্ষামূলক ভ্রমণে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন অঙ্কিতা (নাম পরিবর্তিত)। প্যারাগ্লাইডিং করতে গিয়ে বিপত্তি! আকাশে উড়তেই প্রবল ভয় চেপে বসে। সেই ভয় এতটাই যে, দ্রুত তাঁকে নামিয়ে আনতে হয়। হৃৎস্পন্দন প্রবল ভাবে বেড়ে গিয়েছিল বছর উনিশের মেয়েটির। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্থিতিশীল করতে দ্রুত ওষুধ দেওয়া হয় তাঁকে। তার পর থেকে বহুতলে উঠতে পারতেন না তিনি। উঁচু জায়গা দেখলেই এড়িয়ে যেতেন।
ঘটনা ২: নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন অয়ন (নাম পরিবর্তিত)। ক্লাস হত কখনও নীচের তলায়, কখনও এক তলায়। তা নিয়ে অসুবিধা ছিল না। তবে গ্রন্থাগারে যেতে গিয়ে সমস্যার সূত্রপাত। বেশ কয়েক তলার উপরে গ্রন্থাগারে যেতে গেলেই প্রবল ভয় চেপে বসত মনে। সেখানে পড়াকালীন কোনও দিনই সেখানে যেতে পারেননি ওই ছাত্র।
উঁচুতে উঠলেই প্রবল ভয়! ছবি: সংগৃহীত।
দু’টি ঘটনা আলাদা। তবে এঁদের দু’জনেরই ভয় উচ্চতায়। মনোরোগ চিকিৎসক অম্লানকুসুম জানা বললেন, ‘‘উচ্চতাজনিত এই ভয়কেই বলে অ্যাক্রোফোবিয়া। অর্থাৎ, উঁচুতে উঠলেই মনের মধ্যে চেপে বসে একটি ভয়। আদতে কিন্তু তার কোনও যুক্তি নেই। লিফ্টে করে ওঠার সময়ে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েই বা কেন পড়ে যাবেন? তবু ওই যে মনে হচ্ছে, আমি অনেক উঁচুতে উঠছি, তাতেই ভয়। কখনও পড়ে যাওয়ার ভয়, আবার কখনও ভয়টা ঠিক কী, রোগী নিজেই বোঝেন না। তার জেরেই আচমকা কারও বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে যায়, কারও ঘাম হতে শুরু করে, কারও আবার শরীর অবশ হয়ে আসে। ’’
উচ্চতার ভয় ঠিক কতটা উঁচুতে গেলে হয়? চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর কথায়, ‘‘সাধারণত দোতলা-তিন তলায় এই ভয় হয় না। তবে সাত-আট তলা বিল্ডিংয়ে উঠতে গিয়েই অনেকের শুরু হয়ে যায় ধুকপুকানি। অনেকেই বহুতল দেখলে উঠতেই চান না। কাউকে আবার জোর করে তুললে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকিও থাকে।’’
কখন বুঝবেন অ্যাক্রোফোবিয়া?
উঁচু থেকে নীচে তাকালে অনেকেরই মাথা ঘুরে যায়। ১৭-১৮ তলা থেকে নীচে নামতে গেলে অনেকেরই বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। এ সবই কি উচ্চতা সংক্রান্ত ভয়? এমন হলেই কি ধরে নিতে হবে তাঁর অ্যাক্রোফোবিয়া রয়েছে? এই যেমন মেয়েটি প্যারাগ্লাইডিং করতে গিয়ে ভয় পেয়েছিলেন, আকাশে ওড়ার পর অত উঁচু থেকে নীচে দেখলে বহু মানুষেরই মাথা ঘুরতে পারে, শরীর খারাপ লাগতে পারে। কারণ, তিনি তো প্রথম বার সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন। আগে এত উঁচুতে ওঠেননি।
অম্লানকুসুমবাবু জানাচ্ছেন, উঁচু থেকে নীচে তাকালে ভয় হতে পারে যে কোনও মানুষেরই। কিন্তু তা সাময়িক। সেই ভয়ের প্রভাবে পরবর্তী কালে যদি দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় তবে বুঝতে হবে তা স্বাভাবিক নয়। সেই মানুষটির সঙ্গে বার বার কথা বলে, তাঁর আচরণ দেখে চিকিৎসক বুঝতে পারেন তিনি অ্যাক্রোফোবিয়ার শিকার কি না। এই যেমন মেয়েটির ক্ষেত্রে, প্যারাগ্লাইডিং-এর অভিজ্ঞতার পর তিনি বেড়াতে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কোনও বহুতলে উঠতেন না। এমনকি, বহুতলে অফিস হওয়ায় চাকরি করতেও রাজ হননি। এটা স্বাভাবিক নয়।
দৈনন্দিন জীবনে কী ভাবে প্রভাব পড়ে?
সুবর্ণবাবু জানাচ্ছেন, অ্যাক্রোফোবিয়া থাকলে তিনি কিছুতেই বহুতলে উঠতে চাইবেন না। এমন অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে, উঁচু তলায় অফিস হওয়ায় অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। উঁচু তলার কোনও খোলা ছাদের রেস্তরাঁয় তাঁরা যেতে পারেন না। কেউ হয়তো সারা জীবন পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে বা কাজে গেলেন না।
ভয় আর কোথায়?
অনেকে বিমানেও চড়েন না। সব সময়ে তাঁর মনে ভয়, যদি ভেঙে পড়ে যায়। তবে বিমানে না চড়ার কারণ হতে পারে ভিন্ন। কারও বদ্ধ জায়গায় ভয় হয়। তাকে বলা হয় ক্লসট্রোফোবিয়া। বিমানের মধ্যে বদ্ধ জায়গায় থাকতে হবে, সেই ভয়েই অনেকে তা এড়িয়ে যান। কারও আবার জীবনে কোনও দুর্ঘটনার স্মৃতি থাকলে ভয় হতে পারে। ভয়টা ঠিক কোথায়, তা চিকিৎসকেরাই বুঝতে পারবেন।
কেন হয় অ্যাক্রোফোবিয়া?
পারিবারিক ইতিহাস থাকতে পারে। বাড়ির কাউকে ভয় পেতে দেখলে মনে ভয় তৈরি হয়। আবার কখনও কোনও ভয়ের স্মৃতি, তা নিজের সঙ্গে না ঘটলেও, এই ধরনের ফোবিয়া হতে পারে। তবে সঠিক ভাবে অ্যাক্রোফোবিয়ার কারণ বলা সম্ভব নয়। এমনই বক্তব্য চিকিৎসকদের।
ছোট থেকেই কি ফোবিয়া থাকে?
উচ্চতায় ভয় আছে কি না, বুঝতে গেলে তাঁকে উচ্চতায় যেতে হবে। সাধারণত কেউ দোতলা বাড়িতে থাকেন। দৈনন্দিন জীবনে কখনও উঁচু তলায় যেতে হয়নি, কখনও পাহাড়ে যাননি। তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভবই নয় উচ্চতায় ভয় রয়েছে কি না। এটা তখনই ধরা পড়ে, যখন কেউ বহুতলের ছাদে গিয়ে ভীষণ ভয় পান অথবা উঁচু তলার বারান্দায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাহাড় থেকে নীচে তাকিয়ে এতটাই কেউ ভয় পেয়ে যান যে, তাঁকে স্বাভাবিক করতে ওষুধের প্রয়োজন হয়।
অজয় দেবগণেরও কি অ্যাক্রোফোবিয়া আছে?
বিভিন্ন ছবিতে ‘অ্যাকশন হিরো’ অজয় দেবগণের লড়াইয়ের দৃশ্য বার বার মুগ্ধ করেছে দর্শকদের। নায়ক মানেই তিনি মুহূর্তে শত্রুকে ধরাশায়ী করবেন, পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেবেন, বহুতল থেকে লাফিয়ে পড়বেন, তেমনটাই মনে গেঁথে যায়। কিন্তু জানেন কি রুপোলি পর্দায় শত্রুকে পিটিয়ে হাততালি পাওয়া নায়কেরও উচ্চতাজনিত ভয় আছে?
‘শিবায়’ নামে একটি ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে উত্তরাখণ্ডের একটি পাহাড় থেকে ঝুলে থাকার দৃশ্য সমাজমাধ্যমে দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘উচ্চতাজনিত ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। আপনারা কি সাহায্য করবেন?’’ তবে সেই ভয় তিনি এত দিনে কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।
চিকিৎসার প্রয়োজন কখন?
অনেক উঁচু থেকে নীচে দেখলে কমবেশি অনেকেই ভয় পান। তবে সেই ভয়ের কারণে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, বার বার এমন ঘটে, তবে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসার পাশাপাশি, এ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিংয়েরও প্রয়োজন হয়।
চিকিৎসায় সেরে যায় কি অ্যাক্রোফোবিয়া?
অ্যাক্রোফোবিয়ার চিকিৎসার জন্য সাইকো থেরাপির প্রয়োজন। অম্লানকুসুমবাবু জানালেন, তাৎক্ষণিক ভাবে উদ্বেগ কমানোর জন্য রোগীকে ওষুধ দেওয়া হয়। পরের ধাপে কয়েক মাস ধরে উদ্বেগ কমানোর চিকিৎসা করা হয় ওষুধের দ্বারা। যাতে উদ্বেগের মাত্রা, অন্যান্য সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে, মূল চিকিৎসা হয় সাইকো থেরাপির মাধ্যমে। ‘এক্সপোজ়ার ট্রিটমেন্ট’-এর সাহায্যে ভয় কাটানোর চেষ্টা করা হয়। যেমন চার তলায় উঠতে ভয়। তাঁকে বোঝানো হয় প্রথমে চার তলা থেকে পড়া যাওয়ার কোনও ঝুঁকি নেই। তাঁকে ভরসাযোগ্য কোনও মানুষের সঙ্গে সেখানে উঠতে বলা হয়। সেই সময়ে ওষুধ চলে বলে উদ্বেগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে। চার তলায় ওঠার পর তাঁর অস্বস্তি হতে পারে। তখন তাঁকে কিছু হালকা ব্যায়াম করতে বলা হয়, যাতে ভয়টা নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক থাকতে পারেন। যেমন গভীর ভাবে শ্বাস নেওয়া ও আনুষঙ্গিক কিছু ব্যায়াম। এ ভাবে ধীরে ধীরে তাঁর ভয় কাটানোর চেষ্টা করা হয়। তার পর ওষুধ বন্ধ করার পরও এই ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলা হয়। এ ভাবেই একসময় তিনি ভয়কে কাটিয়ে উঠতে পারেন।