Kleptomaniac

মুছে ফেলুন আঙুলের আঠা

বাক্সটা যত বার দেখে, তত বারই খুব লজ্জা হয় বার্বির। জিনিসগুলো যে খুব অসাধারণ তা নয়।ওগুলো কোনও দিন সে ব্যবহারই করেনি।

Advertisement

সুবর্ণ বসু 

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:১৫
Share:

ছোট্ট বার্বি ক্লাস সিক্সে পড়ে। তার টেবিলের ড্রয়ারে আছে একটি গোপন বাক্স। নানা জিনিসে বোঝাই। ক্লাসমেট অনুষ্কার সেন্টেড ইরেজ়ার, উন্মেষার জেল পেন, শপিং মলের ডিসপ্লে থেকে তুলে নেওয়া গোল্ডেন নেলপলিশ, ইংলিশ টিচারের স্টিক অন প্যাড আরও কত কী! স্টিক অন বলতে মনে পড়ে গেল, বার্বি নেট সার্চ করে দেখেছে, তার এই স্বভাবটাকে বলে স্টিকি ফিঙ্গার, ভাল নাম ক্লেপটোম্যানিয়া।

Advertisement

বাক্সটা যত বার দেখে, তত বারই খুব লজ্জা হয় বার্বির। জিনিসগুলো যে খুব অসাধারণ তা নয়।ওগুলো কোনও দিন সে ব্যবহারই করেনি। সে শুধু জানে, ওই মুহূর্তে অসম্ভব তীব্র একটা ছটফটানি হয়! চুরি করলেই মনটা শান্ত হয়ে যায়। তবে বার্বি একা নয়, ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে আমাদের আশপাশের বহু মানুষই এই সমস্যার শিকার।

এই রোগটি কিন্তু খুব সাধারণ নয়, বরং বিরল ধরনেরই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “সাধারণত যদিও বয়ঃসন্ধিতে কিংবা আরও কম বয়সে রোগটা প্রকাশ পায়, তবে পরিণত বয়সেও এই রোগের সূচনা হতে পারে। রোগটা নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল বলে প্রমাণিত হয়নি, তাই যে কোনও বয়সেই রোগটির বহিঃপ্রকাশ হওয়া সম্ভব। সাধারণ জনসংখ্যা হিসেব করলে ক্লেপটোম্যানিয়া রোগটা খুব বিরল। প্রতি হাজারে ৩ থেকে ৬ জন।” কাকে বলে ক্লেপটোম্যানিয়া?

Advertisement

কনসালট্যান্ট সাইকোথেরাপিস্ট জলি লাহা বললেন, “এটি এক ধরনের ইমপাল্্স কন্ট্রোল ডিজ়অর্ডার। এই ধরনের মানুষেরা কোথাও অবাঞ্ছিত বা অবহেলিত বোধ করে। অথচ তাদের সে অর্থে কোনও অভাব নেই। তবু যেন কোনও কিছু কারও অজান্তে না নিয়ে নিলে এদের হয় না। এখানে কারও কাছে চাইতে হচ্ছে না, বিনিময়ে কিছু দিতে হচ্ছে না অথচ তার প্রয়োজনের জিনিসটি হস্তগত হচ্ছে, এই বোধটা তাদের মানসিক তৃপ্তি দেয়। যদিও পরে এটা নিয়ে তাদের টেনশন হয়, ধরা পড়ার ভয় হয়। তবু সেই মুহূর্তে তারা নিজেদের আটকাতে পারে না।”

ক্লেপটোম্যানিয়ায় কারও ক্রমাগত ইচ্ছে হয় বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি এবং মজুত করার। এক জন ক্লেপ্টোম্যানিয়াক সচেতন ভাবেই এই কাজ করেন, কিন্তু এই প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাঁর নেই। অনেক সময়ে লোকলজ্জার ভয়ে পরিবারের বড়রা প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। ছোটদের বকাবকি কিংবা মারধরও করেন, তবে এতে সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় না।

নিজে নিজে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে?

প্রশ্নের উত্তরে জলি লাহা বললেন, “এই রোগটি যে একই মনস্তাত্ত্বিক উৎস থেকে সকলের হবে, তা কিন্তু নয়। অনেক সময়ে প্রিয় বন্ধুর প্রতি ভালবাসা থেকে কেউ তার জিনিস চুরি করে নেয়, কারণ বন্ধুর মতো হওয়া বা তার সঙ্গে নিজেকে মেলানোর জন্যই সে তার জিনিস নিয়ে নেয়। আবার একটি মেয়ের ক্ষেত্রে দেখেছি, তাদের বাড়ির পরিস্থিতি পুরুষ-প্রধান মানসিকতার। মেয়েটি তাই শুধু অনেক পেন কেনে কিংবা চুরি করে। পেন কেনার প্রয়োজনে সে অন্যের ব্যাগ থেকে না বলে টাকাপয়সাও নিয়ে নেয়। এখানে পেন মেয়েটির কাছে ‘মেল-সিম্বল’ বা পুরুষ-চিহ্নের প্রতীক। তাই রোগের চিকিৎসা করার জন্য সাইকোথেরাপিস্টের সাহায্য অবশ্যই প্রয়োজন, যিনি বারবার সেশন করে রোগের মনস্তাত্ত্বিক উৎস পর্যন্ত পৌঁছে রোগীকে সাহায্য করতে পারবেন।”

ক্লেপটোম্যানিয়া কেন হয়?

ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “রোগটা জেনেটিক হতে পারে এবং মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড পাথওয়ের উপরে প্রভাব ফেলে। রিওয়ার্ড পাথওয়ে ডোপামিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ডোপামিন সিক্রেশন সাপ্রেস করতে পারে এমন ওষুধ দিয়ে এর চিকিৎসা করা যায়। দেখা গিয়েছে, যদি কারও ক্লেপটোম্যানিয়া থাকে, তার ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভের মধ্যে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ়অর্ডার কিংবা সাবস্ট্যান্স-ইউজ় ডিজ়অর্ডার অর্থাৎ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার ক্লেপ্টোম্যানিয়ায় ভুগছেন এমন অনেক রোগীর চুরিজনিত কারণে অপরাধ বোধ, অবসাদ কিংবা নেশা করার প্রবণতা তৈরি হয়। এগুলোকে কোমর্বিডিটি বলা হয়। সেগুলোর জন্য আলাদা আলাদা ভাবে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং অন্যান্য সাইকোথেরাপি ক্লেপটোম্যানিয়ার চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয়।”

ক্লেপটোম্যানিয়া কিন্তু চুরি নয়। কারণ যারা চুরি করে স্বেচ্ছায় এবং প্রয়োজনে, তাদের অপরাধবোধ থাকে না। এরা সোসিয়োপ্যাথিক অপরাধী বা অপরাধমনস্ক। কিন্তু ক্লেপটোম্যানিয়ায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা চুরি করেন শুধু একটা চাঞ্চল্য নিরসন এবং তার মাধ্যমে আনন্দ পাওয়ার জন্য। বাস্তব প্রয়োজনের জন্য নয়। সেই কারণেই তাদের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হয়, যা সাধারণ চুরির ক্ষেত্রে হয় না। ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, “অসুখটা যখনই ধরা পড়ুক, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হওয়া আবশ্যক। কারণ রোগটা ঠিকমতো শনাক্ত করতেও বিশেষজ্ঞের মতামত প্রয়োজন হয়। আবার এর একটা আইনি দিকও আছে, কোনও সাধারণ চোর কিংবা পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডারের কেউ যদি চুরি করে ধরা পড়ে এবং বলে যে তার ক্লেপটোম্যানিয়া আছে, তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে কথার সত্যাসত্য যাচাই করার জন্যও বিশেষজ্ঞের মতামত প্রয়োজন।”

ক্লেপটোম্যানিয়া কি ওসিডি?

মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই, ওসিডি বা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ়অর্ডার। জলি লাহা জানাচ্ছেন, “ক্লেপটোম্যানিয়া কিন্তু ওসিডি নয়। ওসিডির একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। ক্লেপটোম্যানিয়ায় তা নেই। কোনও ব্যক্তি বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে কিছুতেই মনে করতে পারেন না ঘরের আলো-পাখা নিভিয়েছেন কি না, আবার তালা খুলে সব চেক করে নেন। এটা ওই ব্যক্তি যত বার বাইরে বেরোবেন তত বারই হবে। ক্লেপটোম্যানিয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু কেউ দশ বার শপিং মলে গেলে প্রত্যেক বারই শপলিফ্ট করবেন না। হয়তো কুড়ি বারে এক বার করলেন, তাও নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’’

সমস্ত মনের সমস্যার মতো এই অসুখেরও চিকিৎসা আছে, আরোগ্যও আছে। প্রয়োজন শুধু সচেতন হয়ে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার। এই সমস্যা ফেলে রাখলে শুধু ব্যক্তির নয়, তার পরিবারেরও অসম্মানের কারণ হয়ে পড়ে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি না করাই ভাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement