‘কারুবাসনা’র ‘হেম’-এর আখ্যান যেন প্রতিনিয়ত আরও রুক্ষ হয়ে যাওয়া এই জগতে কোথাও গিয়ে হঠাৎ একটা আয়না খুঁজে পাওয়া।
‘এ সবই কথার কথা,
রুজি রোজগার খুঁজতে তার সারাদিন হয়রানি
তাকে ঘিরে হতশ্রী সংসার
তাও রোজ রাত্রিবেলা বালতি করে গলে যাওয়া লোহা তুলতে গিয়ে
হাত পোড়া, বুক পোড়া ওই মানুষটা পাহাড়ের ঢালে জ্ঞান হারিয়েছে’
অ্যাকাডেমিতে সন্ধে ৬টার শো। অন্ধকার দর্শকাসনে বসে জীবনানন্দের ‘কারুবাসনা’র ‘হেম’-কে দেখছেন সকলে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তাঁরা নীলচে আলো মাখানো ওই দু’টি অবয়বের দিকে। একটা মৃদু সুর বাজছে পিছনে, সামনে ‘হেম’ বলে চলেছে কত কথা। কখন যে সেই কথাগুলি ‘হেম’-এর চরিত্র ছাপিয়ে দর্শকাসনে বসে থাকা প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছে একটু একটু করে, তা হয়তো সেই মানুষগুলিও অত সহজে বুঝে উঠতে পারেননি।
নিত্যদিনের ইঁদুর দৌড়ে ক্লান্ত প্রত্যেকেই। মানসিক চাপের ভারে নুয়ে পড়ছে তাঁদের শরীর-মন দুই-ই। তাই ‘হেম’-এর এই আখ্যান যেন নিছক দারিদ্রকে রোমান্টিকতার মোড়কে মুড়ে ফেলা নয়, বা কোনও রকম মায়াবি আবেশে দুঃখ ভুলিয়ে রাখা নয়— বরং প্রতিনিয়ত আরও রুক্ষ হয়ে যাওয়া এই জগতে কোথাও গিয়ে হঠাৎ একটা আয়না খুঁজে পাওয়া।
একবিংশ শতাব্দীর এই পুঁজিবাদের রাজত্বে সব কিছুই যেন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে চায়। যত বেশি আগ্রাসন ঘটে পুঁজিবাদের, ততই মানুষের মধ্যে আরও ক্ষুদ্র হতে থাকে সহানুভূতির পরিসর। আর ক্রমাগত আরও বেশি সৌহার্দ্যহীন হয়ে চলা পৃথিবীতে আরও চেপে বসে অবসাদ। যেন অবসাদের প্রবণতা, মানসিক ক্লান্তির প্রবণতা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে এই ‘নিজেরটা বুঝে নেওয়ার’ জগতে। সঙ্গে এই বারবার ‘আরও চাই’-এর স্রোতে মানুষের অস্তিত্ব আর সংখ্যার বর্ধনশীল চাহিদা কেমন যেন মিলেমিশে যায়। আরও ক্লান্তি, আরও চিন্তা, আরও হেরে যাওয়া, বিশাল ভয়ংকর পাহাড়ের আকার নেয় অবসাদ— বিতৃষ্ণায় বুজে আসে চোখগুলি। এমন সময়ে কোনও জানলা চায় মানবমন। এমন এক আশ্রয় চায় যেখানে এই দৈনন্দিনতার শৃঙ্খল থাবা বসাতে পারবে না মনের মধ্যে, এই দৌড়ের ক্লান্তি তাকে ছুঁতে পারবে না। তখন সেই মনগুলিকে ধরে রাখে শিল্প। তাঁকে বটগাছ-সম আশ্রয় দেয় সঙ্গীত, সাহিত্য, থিয়েটার, সিনেমা। আশ্রয় হিসেবে দেখা দেয় একটি গিটার, একটি গান, কখনও কলমের মধ্যে দিয়ে আর্তনাদের মতো বেরিয়ে আসে কবিতারা, আবার কখনও থিয়েটার হয়ে ফেটে পড়ে সে মঞ্চের উপর।
আলো নিভে গিয়েছে মঞ্চের, কিন্তু চুপ করে বসে থাকেন তাঁরা।
আশ্রয় ঠিকই, কিন্তু তা কি কোনও ওষুধ? যদি কেউ অবসাদের কবলে পড়ে থাকেন, তবে শিল্প তাঁকে ধরতে পারে, তাঁর ব্যথায় ব্যথিতও হয়তো হতে পারে, কিন্তু তাঁর অবসাদ দূর হবে কী? তার জন্য হয়তো শিল্পের পাশাপাশি প্রয়োজন মনোবিদের সান্নিধ্য। যে তাঁর সঙ্গে পথ চলবে এই গোটা অবসাদের মধ্য দিয়ে।
সেই কথাই বারবার বলেছেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘‘যদি কিছু করে আপনি আরও ভাল থাকেন বা সুস্থ অনুভব করেন, তার মানেই সেটা ‘থেরাপি’ নয়। একজন মানুষ থিয়েটার করে সত্যিই আরও ভাল বোধ করতে পারেন, কিন্তু তার মানেই যাঁর সান্নিধ্যে তিনি থিয়েটার করছেন তিনি ‘থেরাপিস্ট’ হয়ে গেলেন না। থিয়েটারের ওয়ার্কশপ কারও সেটা ভাল থাকার একটা পথ বা সহায়ক হতে পারে, কিন্তু তাকে থেরাপির সমতুল্য বলতে পারি না। শিল্পকে থেরাপি হিসেবে নিশ্চয়ই ব্যবহার করা যায়, তবে তার জন্য নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞের সাহায্য প্রয়োজন।’’ অবশ্য মানসিক সুস্থতা-অসুস্থতার বিষয়গুলি একান্তই আপেক্ষিক, এবং বহুমাত্রিক। কারও জন্য একাকীত্বটাই একটা সমস্যা হতে পারে, কেউ আত্মবিশ্বাসের বিপুল খামতিতে ভোগেন, আবার কারও জন্য আরও হয়তো আরও গভীরে বীজ বোনা থাকে সেই অবসাদের। সেই বিষয়ে অনুত্তমা মনে করান, ‘‘কারও যদি সমস্যাটাই হয় একাকীত্বের, তা হলে তিনি কোনও থিয়েটার গ্রুপে যোগ দিলে সেটাই তার সমস্যার ওষুধ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যদি তার আরও কিছু গভীর সমস্যা থেকে থাকে, কোনও অমিমাংসিত দ্বন্দ্ব, উদ্বেগ, অবসাদ থেকে থাকে, তা হলে কোনও নাটকের দলে যোগ দিলে তার সাময়িক একটা মুক্তি হতে পারে। কিন্তু তিনি যখন আবার নিজের কাছে ফিরে যাবেন, তাঁর ফের সেই চিন্তাগুলো উঠে আসবে। সে ক্ষেত্রে থেরাপি নিজের সঙ্গে একটি সংলাপে নিযুক্ত হতে শেখায়।’’
অবসাদ থেকে জন্ম নেয় অসহায়তা, অসহায়তা থেকে বেড়ে ওঠে নিস্তব্ধতা। আরও চুপ করে যায় মনগুলি। তখন ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’-য় চাঁদ সুলতানা আর মনসুরকে ভেসে যেতে দেখে হয়তো হঠাৎ কিছুক্ষণের বাঁধ ভাঙে। ‘পানি যায়, ভেসে যায়, দূরে যায় দরিয়ায়’-র সুরে মন চঞ্চল হয়ে উঠবে হয়তো তাঁদের। আলো নিভে গিয়েছে মঞ্চের, কিন্তু চুপ করে বসে থাকেন তাঁরা। ওই আরামের মুহূর্তগুলি তাঁদের ধাক্কা দেয় হয়তো। থিয়েটার থেরাপিস্টের জায়গা নিতে পারে না, ওষুধও নয় অবসাদের। তবুও কোথাও গিয়ে হয়তো তা এক পথ হয়ে দাঁড়ায়।
থিয়েটারে বাস্তবের আর কল্পনার মিলন ঘটে যৌথতার মধ্যে দিয়ে, জন্ম নেয় সাহিত্য।
‘‘যে কোনও শিল্প এক ধরনের প্রস্থান। মানুষ প্রস্থান কেন চায়? যদি আক্ষরিক অর্থেই আমরা প্রস্থানের কথা বলি, তা হলে তো একটা বেরিয়ে যাওয়া, বা চলে যাওয়া বোঝায়। এই একটা একঘেয়েমির পরিসর থেকে উত্তরণের আশাতেই কোথাও একটা চলে যাওয়া। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’-তে আছে যে, কেন মদ খাচ্ছে ফাগুলাল? এই যে ভয়ানক দৈনন্দিন যাপনের যন্ত্রণা, সেই অসুস্থতাকে ভুলিয়ে দিতে আরও বৃহত্তর এক অসুস্থতাকে সে আপন করে নিচ্ছে। কোনও ভাবে এই অসুস্থতাই এক উপশমের কাজ করছে। ভেঙে পড়া মানুষ বার বার ঈশ্বরের কাছে ফিরে যেতে চায় কেন? ওই একই! একটা আশ্বাস পেতে চায়, একটা শুশ্রূষা পেতে চায়। যে কোনও শিল্পই এই ধরনের এক প্রস্থান। তা ঠিক মদ খাওয়া নয়, বরং আরও প্রকৃত এক শুশ্রূষার কাজ করে। সেই বাস্তবতারই এক উদ্যাপনে তাকে পৌঁছতে হয়। ‘বাস্তবতা নেই’, এ রকম একটা অলীক কল্পনার ভিত্তিতে কোনও ‘প্রস্থান’ কিন্তু নেই এখানে,’’ বলছেন নাট্যব্যক্তিত্ব জয়রাজ ভট্টাচার্য।
জয়রাজ মনে করান, অন্যান্য বেশির ভাগ শিল্পমাধ্যমে একটা আর্কাইভাল মূল্য থাকে, কিন্তু থিয়েটারের মতো মাধ্যমে সবটুকুই একদম সরাসরি হয়ে যায়। জীবনানন্দ দাশ ভয়ানক বিমর্ষতার মধ্যে দাঁড়িয়ে হয়তো একটি কবিতা লিখলেন। কিন্তু কোনও না কোনও স্তরে কবিতাটি পঠিত হোক তিনি তো চাইছেন, যাতে এক ধরনের যোগাযোগ স্থাপন হয়। কিন্তু লেখার পরক্ষণেই যে সেই যোগাযোগ স্থাপন হবে, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই! ‘‘একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে থিয়েটার। আমি যে মুহূর্তে থিয়েটার করছি, যদি সেই মুহূর্তে কোনও রকম উপশম পাওয়া যায়, সেটাই সব। সেই মুহূর্তেরই রচনা, সেই মুহূর্তেই যোগাযোগ। এখনই আমার কিছু বলার আছে, এবং এখনই আর একজন মানুষের কিছু শোনার আছে। দুটো অবস্থানের এই যে এক সংবেদ তৈরি হল, যা দৈনন্দিনতার মধ্যে থেকে উঠে এলেও, কোথাও গিয়ে তার থেকে একটা উত্তরণ ঘটাচ্ছে।’’ শুশ্রূষা মানুষ সঙ্গে সঙ্গে চান। যে মুহূর্তে অসুস্থতা, সে মুহূর্তে উপশম। থিয়েটার সেই উপশম দেয় সেই সময়ই। যিনি শোনাচ্ছেন তাঁর জন্য, যিনি দেখছেন তাঁর জন্যেও। সেই কারণেই থিয়েটার এত এত যুগ ধরে টিকে রয়েছে, মনে করিয়ে দেন জয়রাজ।
যে কোনও শিল্পের ধারাই এক ধরনের উত্তরণের সাহায্য করে। হয়তো অবসাদের ওষুধ নয়, কিন্তু অবসাদগ্রস্ত, আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগা মনগুলির আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে থিয়েটার। ধরা যাক ‘তিতুমীর’-এর সেই ইনকিলাবের সংকল্প, বা ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’-র মনসুর আর চাঁদ সুলতানার সেই ট্র্যাজিক প্রেমের আর্তনাদ— কোথাও গিয়ে নানা অনুভূতির মধ্যে জড়িয়ে ফেলে সকলকে। বাদল সরকারের ‘মিছিল’-এর সেই বাস্তবকে আরও বেশি করে তুলে ধরা, বা বিজন ভট্টাচার্যের কালজয়ী রচনা ‘নবান্ন’-এর সেই সাহসী মূর্ছনা— থিয়েটার যুগের পর যুগ ধরে মানুষের মনে বীজ বুনেছে বাঁচার তাগিদের। সেই বৃত্তাকারে ঘুরে চলা ক্লান্তিকর দৈনন্দিনতার বাইরে এক মানসিক শান্তির জন্য, উদ্যমের জন্য, এক অন্য জীবনযাপনের খোঁজ দেয় থিয়েটার। শুধু যিনি দেখেন তাঁর জন্য নয়, যিনি মঞ্চে রয়েছেন, তিনিও যেন সেই উপশমকে উপভোগ করছেন ক্রমাগত। নিজের ভিতরের সেই যন্ত্রণার যাপনকে নিঙড়ে দিতে চাইছেন তিনি। হয়তো মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়বেন, বা কিছু ক্ষণ বাধ্য হবেন চুপ করে থাকতে। থিয়েটার বার করে আনে সেই চেপে রাখা সবটুকুকে। তারই বিচ্ছুরণ ঘটে থিয়েটারে, একাধিক চেপে রাখা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে যায় এখানে। শুধুমাত্র ওই দু’-তিন ঘণ্টার একটা মঞ্চায়ন নয়, সেই থিয়েটারকে কেন্দ্র করে এক যাপন গড়ে ওঠে। নিজের চারপাশের বিষণ্ণতা থেকেই তুলে আনা হয় এক একটি নাটক। থিয়েটার মদ্যপান নয় যে, আসক্তির জোরে সব কিছু ভুলিয়ে রাখবে। থেরাপিও নয়, যে সব সমস্যা সারিয়ে তুলবে। থিয়েটার একটি সত্তা, একটি যাপন, একটি অন্য জীবনধারার সন্ধান দেয়। যেখানে বাস্তবের আর কল্পনার মিলন ঘটে যৌথতার মধ্যে দিয়ে, জন্ম নেয় সাহিত্য। থিয়েটার একটি সংকল্প, একটি সুস্থতার খোঁজে প্রতিনিয়ত চলতে থাকার এক যাপন। যা যুগের পর যুগ ধরে যোগাযোগ স্থাপন করেছে সকলের সঙ্গে সকলের।
‘— মানুষটা পড়েই থাকবে?
নাকি সে ধড়মড় উঠে গা থেকে জড়ানো
ওই লৌহসর্প খুলে বাঁকিয়ে আবার গড়বে রূপ, মূর্তি, ছন্দ, বাঁক?
ধরবে? সে অদৃষ্টপূর্ব গতি আর পথ?
কী হবে জানি না,
শুধু আমরা দূর থেকে দেখছি,
জানলা দিয়ে আলো আসছে,
খসখস পেন্সিল চলছে
আর জানলার বাইরে রাত জেগে লেখা নিতে এসে
একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাবিকাল।’