বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লক নির্মল হিসাবে ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। ব্লক জুড়ে বাড়ি বাড়ি শৌচাগার গড়ার প্রয়াস কিন্তু একদিনে বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশাসনের আধিকারিকেরা ব্লকের বিভিন্ন গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছেন। অনেকেই প্রাথমিক ভাবে আপত্তি তুলেছেন। অথচ, সেই ব্লকেরই প্রত্যন্ত শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। গ্রামের বাসিন্দারা তার আগেই নিজের নিজের বাড়িতে শৌচাগার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। কী ভাবে? সেখানকার এক গৃহবধূ দয়াময়ী গড়াই তত দিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাসিন্দাদের শৌচাগারের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেছেন। ফলে কাজ সহজ হয়ে গিয়েছিল প্রশাসনের। স্বীকৃতিস্বরূপ জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে তাঁকে শংসাপত্রও দেওয়া হয়।
প্রশ্ন: দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লক নির্মল হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগে আপনিও সামিল হয়েছিলেন বলে শুনেছি।
উত্তর: হ্যাঁ। আমি আমার মতো করে এগিয়ে এসেছি। সরকারি উদ্যোগেরও আগে থেকে নেমে পড়েছিলাম। সরকার এগিয়ে আসায় কাজ সহজ হয়।
প্রশ্ন: আপনি কী ভাবে ‘নির্মল বাংলা’ অভিযানে যুক্ত হলেন?
উত্তর: আমি গরিববাড়়ির বউ। অন্যের বাড়িতে ধান সিদ্ধ করে, মুড়়ি ভেজে, গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু এটা বুঝেছিলাম, মেয়েরা মাঠে গেলে মান কমে। বাড়়িতে একটি শৌচালয় থাকলে মান বাড়়ে। নিজের বাড়়িতে পাকা শৌচালয় বানিয়েছি। অন্যকেও বলেছি সুবিধার কথা।
প্রশ্ন: বাড়়িতে শৌচালয় কবে বানিয়েছেন?
উত্তর: প্রথম বার বানিয়েছিলাম ১৫ বছর আগে। তখন গ্রামে হাজার দুয়েক পরিবারের মধ্যে আট-ন’টি ঘরে পাকা শৌচাগার ছিল। ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার পরে বাড়়িতে লোকসংখ্যা বাড়়ে। তা ছাড়া পুরনোটি অকেজো হয়ে গিয়েছে। তাই এক বছর আগে নিজেরাই আর একটি নতুন শৌচাগার গড়়েছি।
প্রশ্ন: শৌচাগার গড়তে আপনি সরকারি সাহায্য পেয়েছিলেন?
উত্তর: তখনও তো এই ভাবে প্রচার ছিল না। তাই জানতাম না। আমাদের পাকা শৌচাগার গড়ে ফেলার পরে লোকমুখে জানতে পারি শৌচাগার গড়ার জন্য সরকারি সাহায্যও দেওয়া হয়। তবে মিশন নির্মল বাংলা অভিযান শুরু হওয়ার পরে আর এক দিনও সময় নষ্ট করিনি। গ্রামের প্রতিটি বাড়়ি গিয়ে শৌচাগার গড়ার আর্জি জানাতে শুরু করি।
প্রশ্ন: আপনি কেন এ ভাবে মাঠে নামলেন?
উত্তর: মাঠেঘাটে গেলে, পরিবেশ নোংরা হয়। রোগও ছড়়ায়। বাড়়িতে একটি পাকা শৌচালয় থাকলে মেয়েদের বাইরে যেতে হয় না। কত সুবিধা। আমার বাড়়ি পাকা শৌচালয় থাকায় আমি বুঝেছি কত সুবিধা।
প্রশ্ন: আপনার এই কাজ নিয়ে কেউ টিটকিরি মারেনি কোনওদিন?
উত্তর: কটূ মন্তব্য সে ভাবে শুনতে হয়নি। তবে কেউ কেউ রাগ করেছেন। সামনেই দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। তবে সে ভাবে কেউ আমাকে অসম্মান করেননি কোনও দিন।
প্রশ্ন: আপনি কোন কোন এলাকায় গিয়ে কী ভাবে শৌচালয়ের প্রচার করেছেন?
উত্তর: আমি যেখানেই যাই সেখানে গল্পের ছলে শৌচাগারের কথা বলি। ৯০০ টাকা জমা দিলে ১০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে, সে কথা নিজের গ্রামে, বাপেরবাড়়ি কাঁটাবেরিয়া গ্রামে, এমনকী, কোথাও বেড়়াতে গেলে সেখানেও গল্প করতে করতে সে কথা বলি। অনেকেই আমার কথায় ভরসা করে অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করেন। তাঁদের অনেকেই বাড়়িতে শৌচাগার বানিয়েছেন।
প্রশ্ন: আপনার তো দেখছি মাটির বাড়়ি। কিন্তু শৌচাগারটি পাকা, কী বলেন গ্রামের মানুষ?
উত্তর: গ্রামে অনেকেই পাকা বাড়়ি বানিয়েছেন। কিন্তু তেমন বাড়ির মেয়েরাও মাঠেঘাটে যায়। আমি তখন আমার কথা তাঁদের বলি। আগে পাকা শৌচাগার হোক। পরে পাকা বাড়়িঘর। তাতে কেউ কেউ রাগ করেন। তবে অধিকাংশই একমত হন।
প্রশ্ন: শৌচাগার নিয়ে সরকারি ভাবে জোরদার প্রচার শুরুর আগেও আপনি সম্মান পেয়েছেন?
উত্তর: আমাকে আফিসে ডেকে শংসাপত্র দিয়েছেন বিডিও সাহেব। আসলে, আমি তো বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই প্রচার শুরু করি। তখনও আধিকারিকেরা এ দিকে আসেননি। যখন তাঁরা বাড়়িতে বাড়়িতে বলতে এলেন, তখন গ্রামের অনেকেই আমার কথা বলেন। খুশি হন বিডিও সাহেব। উনি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পরে জেলাশাসকের দফতর থেকেও স্বীকৃতিস্বরূপ শংসাপত্র দেওয়া হয় আমাকে।
প্রশ্ন: আপনার সংসার কী ভাবে চলে?
উত্তর: ছেলেরা বড়় হয়েছে। বড়় ছেলে সিভিক পুলিশে কাজ করে। ছোট ছেলে কাপড়় ফেরি করে। আর স্বামীর একটা চায়ের দোকান আছে। এ ছাড়া বিঘে আড়াই জমি রয়েছে। আর, আমি এই সংসার, গরু-ছাগল নিয়েই আছি। এ ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি কি এখনও মানুষজনকে শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলেন?
উত্তর: ঘরের কাজ সামলে, সকালে মুড়়ি-জলখাবার খেয়ে নাতিদের নিয়ে বের হই। যাঁদের বাড়়িতে এখনও শৌচাগার হয়নি তাঁদের গিয়ে বোঝাই। গ্রামের আর মাত্র ৫ শতাংশ বাড়ি বাকি আছে শৌচাগার গড়়তে।
প্রশ্ন: বাড়়ির লোকেরা আপনাকে কিছু বলে না?
উত্তর: বাড়়ি থেকে কেউ আমাকে বারণ করেনি কোনও দিন। উল্টে ছেলেদের সঙ্গে বৌমারাও আমাকে এ কাজে উৎসাহ দেয়। এটা তো ভাল কাজ। সমাজের জন্য কাজ। রোগজীবাণুমুক্ত নির্মল পরিবেশ পেতে গেলে শৌচাগার গড়া অত্যন্ত জরুরি।