একুশের সেরা ২১

মাম্মি

সুমন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০২
Share:

আজ খুব ভিড় রেস্তোরাঁতে। সাধারণত শনি-রবিবার বেশ ভিড় হয়। আলপনা অনেক ক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, তার অর্ডার দেওয়া পার্সেলটার জন্য। আজ অনুষার আবদার রাতে ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন খাওয়ার। অনুষা আলপনার একমাত্ৰ মেয়ে, কলকাতার নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। সে গিয়েছে রেস্তোরাঁর পাশেই বইয়ের দোকানে বই কিনতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে অনুষা। তখনও আলপনাকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, ‘‘ওহঃ গড! তোমার এখনও হয়নি! হোয়াটস রং উইথ দিস গাইজ়?’’

মুচকি হেসে আলপনা বলে, ‘‘তোর বই কেনা হল? না কি তোর ইংরিজির ঠেলায় ওরা ফেরত পাঠিয়ে দিল!’’

আলপনার কথা শুনে অনুষা প্যানপ্যানে স্বরে বলে, ‘‘মাম্মি, ইংলিশ ইজ় কুল, বাংলা খুব বোরিং।’’ অনুষার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলপনা। সত্যিই তো বাংলা খুব বোরিং। দিনে ক’টা বাংলা কথাই বা বলে অনুষা? ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি করার সময় খুব ইচ্ছে ছিল, অনুষাকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করার। কিন্তু অনুষার বাবা অনুপম এক রকম জোর করেই তাকে ভর্তি করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে। এখনকার দিনে নাকি ইংরেজি মিডিয়াম ছাড়া কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কথাটা সত্যি জানে আলপনা, কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারে না। রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলায় মাস্টার্স। বরাবরের টান বাংলা ভাষার উপর। চেষ্টাও করে সারাদিন যতটা সম্ভব বাংলায় কথা বলা যায়। কিন্তু তার মেয়ে অনুষার সারাদিনটায় বাংলার কোনও অস্তিত্বই নেই। পড়াশোনা, কথাবার্তা সবই প্রায় ইংরেজিতে। নিজে কম চেষ্টা করেনি বাংলা ভাষার উপর মেয়ের টান তৈরি করার। কিন্তু সফল হয়নি। অনুষার মুখ থেকে ‘মা’ শব্দটা শোনার জন্য আলপনার কান নিতান্ত ব্যাকুল। অনেক করে তাকে ‘মা’ ডাকতে বলেও লাভ হয়নি কোনও। এই সব ভাবতে ভাবতে অনুষার ‘মাম্মি’ ডাকে সম্বিৎ ফেরে আলপনার। তাকিয়ে দেখে তাদের নম্বর এসে গিয়েছে। পার্সেল তৈরি। এক হাতে পার্সেল আর আর এক হাতে অনুষাকে ধরে বাড়ির পথে পা বাড়ায় তার ‘মাম্মি’।

বাড়ির দরজায় এসে কলিং বেল বাজায় আলপনা।

‘‘কী গো, এত দেরি? তাড়াতাড়ি এসো, দেখো কে এসেছে!’’ দরজা খুলেই বলে অনুপম। ভিতরে ঢুকে আলপনা দেখে পাশের বাড়ির ঘোষবাবু। সস্ত্রীক বসে আছেন তাদের বসার ঘরের সোফায়। পাশে এক দম্পতি, দেখে বোঝা যাচ্ছে নতুন বিয়ে হয়েছে। ‘‘এই দেখো, ঘোষবাবুর ছেলে আর ছেলের বৌ, আজই এসেছে ব্যাঙ্গালোর থেকে।’’ অনুপম বলে আলপনাকে।

মিষ্টি হেসে আলপনা বলে, ‘‘ওরে বাবা, কত বড় হয়ে গিয়েছে ছেলেটা!’’

উঠে এসে প্রণাম করে নবদম্পতি। পাশে দাঁড়ানো অনুষাও তাদের ‘হাই’ বলে ঠান্ডা হাসে। ‘‘কী গো, কিছু খেতে দিয়েছ ওদের? বসো তোমরা, আমি চা করে আনি।’’

আলপনার কথা শুনে নতুন বৌটি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘‘চলুন কাকিমা, আমি আপনার সঙ্গে যাই।’’

‘‘না না, তুমি বসো, গল্প করো।’’ আলপনা মানা করা সত্ত্বেও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় নতুন বৌটি। গ্যাসে চা বসিয়ে আলপনা জিজ্ঞাসা করে, ‘‘খুব সম্প্রতি তোমাদের বিয়ে হয়েছে, না?’’

লাজুক হেসে মেয়েটি বলে, ‘‘মাস ছয়েক। বিয়ের পর এই প্রথম কলকাতায়। গত কয়েক দিন ধরে খুব ঘুরছি। গতকাল দক্ষিণাপন গিয়েছিলাম। কলকাতায় এসে শাড়ি না কিনলে হয়! আজ তো অনেক মিষ্টি খেয়েছি। রসগোল্লা।’’

হো হো করে হেসে ওঠে আলপনা। মেয়েটা বেশ প্রাণবন্ত, খুব ভাল লাগে আলপনার। ‘‘চা হয়ে গিয়েছে, চলো বসার ঘরে যাওয়া যাক।’’ আলপনা এ বার মেয়েটিকে নিয়ে এগোয় বসার ঘরের দিকে। চায়ের আড্ডায় যোগ দেয় অনুষাও, ‘‘আচ্ছা বৌদি তুমি জব করো? ব্যাঙ্গালোর ইজ় রকিং না?

আমারও খুব ইচ্ছে টু বি দেয়ার।’’

অনুষার কথা শুনে মেয়েটি বলে, ‘‘হ্যাঁ। আমি ওখানে একটা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি করি। ভাল করে পড়াশোনা করো, তুমিও নিশ্চয়ই যাবে।’’ অনুষার গাল ভরে ওঠে চওড়া হাসিতে।

‘‘চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।’’ ঘোষবাবুর তাড়ায় উঠে পড়ে সবাই।

মেয়েটি প্রণাম করতে আসলে আলপনা বলে, ‘‘ভাল থেকো মা, তোমার নামটাই তো জানা হল না।’’ মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলে রজনী ঘোষ আইয়ার।

কিছুটা অবাক হয়েই আলপনা বলে, ‘‘ও মা! তুমি জন্মসূত্রে বাঙালি নও? তা হলে এত পরিষ্কার বাংলা...’’

রজনী বলে, ‘‘আমার জন্ম, বড় হওয়া সব চেন্নাইতে। আমার বর সুপ্রিয় আর আমার সম্পর্ক সাড়ে ৫ বছর। বাঙালি ছেলেকে ভালবাসতে-বাসতে বাংলা ভাষাটাও শিখে গেলাম। আমার বাংলা বলতে খুব ভাল লাগে। আমি বাড়িতে সবার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলি।’’ আলপনা আবেগে আপ্লুত। পাশে দাঁড়ানো অনুষা হতবাক, নীরব। আলপনার হাতটা মাথায় উঠল রজনীর, ‘‘সুখে থাকো, ভাল থেকো।’’ আলপনার তখনও সেই রেশ কাটেনি, ঘোষ পরিবার বিদায় নেয়।

ঘোষেরা চলে গিয়েছে প্রায় ঘণ্টা খানেক। রাতের খাওয়া বাকি, কিন্তু আলপনার মন জুড়ে আজ শুধু রজনী। তার নিজের মেয়ে বলে বাংলা বোরিং, আর বাইরের রাজ্যের ভিন্নভাষীরা শিখে নিয়ে ঝরঝরে বাংলা বলছে। আজ যেন কোথাও না কোথাও তার আবেগ অবুঝ হয়ে পড়ছে। শুয়ে শুয়ে এ সবই ভাবছিল আলপনা। এর মধ্যেই একটা নরম হাত জড়িয়ে ধরে আলপনাকে। আলপনার পিঠের দিকে তার মুখ। ‘‘সরি ‘মা’, আমার খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি তোমায় আর কখনও ‘মাম্মি’ বলে ডাকব না। বাইরের সবাই তো বাংলা ভাষাকে কত অ্যাডমায়ার করে। আর আমি তো বাই বার্থ বাঙালি। তা হলে আমি কেন না? সব আমার ভুল, আমি আর কখনও এ রকম করব না। আমায় ক্ষমা করে দাও ‘মা’, প্লিজ।’’ আলপনার চোখের জল আজ বাঁধ মানছে না। পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে সে অনুষাকে। আজ তো সে তার ‘মা’, ‘মাম্মি’ নয়। মনে মনে আলপনা কৃতজ্ঞতা-মাখা কুর্নিশ জানায় রজনী ঘোষ আইয়ারকে।

Follow us on:
আরও পড়ুন