সাধনের মা আজান বলিতে পারিত না। বলিত আজাম।
প্রত্যুষেই আমি সাধনের বাড়ি যাইতাম মাছ আনিতে। সাধনের মা গাল টিপিয়া আমাকে দাওয়ায় বসাইয়া চুবড়ি হইতে মাছ বাছিতে বাছিতে গল্প করিত, ‘‘সুকু, তোদের ভোরের আজাম আমার খুব কাজে লাগে জানিস? আমি আজাম শুনেই ধান ভাপানোর জন্যে বড় চুলো ধরাতে যাই।’’ আমি একগাল হাসিয়া মাছ লইয়া বাড়ি ফিরিতাম।
বাড়ি ফিরিয়া নয়টা বাজিতে না বাজিতেই কাপড়খানা লইয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে নদীর পানে ছুটিতাম। আমাদের নদী। কুনুড়। অজয়ের উপনদী।
ধর্মের বিভেদ মানিয়া লইয়া পাশাপাশি দুইখানা ঘাট ছিল। একটায় হিঁদুপাড়ার মেয়েরা নাইতে অসিত, হিঁদু ঘাট বলিতাম। আর একখানায় আমরা নাইতাম। নাম ছিল মুসলিম ঘাট। আকারে-প্রকারে দুইটাই সমান। ধর্ম ছাড়া কিছুই পার্থক্য ছিল না। শুধু অলিখিত কোনও দুর্লঙ্ঘ্য নিয়ম মানিয়া একে অপরের ঘাটে যাইত না। তবে শিশুগুলা দুইটা ঘাটের বাধা মানিত না। ডুবসাঁতারের অছিলায় হিঁদুর ছানা মুসলিম ঘাটে আসিয়া ঘাটের উপলখণ্ড উল্টাইয়া রাখিত , আর মুসলমানের ছানা হিঁদুর ঘাটে পাঁক মাখাইয়া আসিত।
বর্ষাকালে যখন অজয়ের বান ডাকাইয়া আসিত, কুনুড় তখন ফুলিয়া ফাঁপিয়া গর্জন করিত। আমার মনে হইত, আমার কুনুড় উদাত্ত কন্ঠে আমায় ডাকিতেছে। দৌড়াইয়া যাইতাম। দুরন্ত শিশু যেমন করিয়া মায়ের কোলে ঝাঁপায়, তেমনই পাড়ের হিন্দোল গাছের ডাল হইতে কুনুড়ের বুকে ঝাঁপাইতাম।
সে বড় সুখের দিন গিয়াছে। একগলা জলে দাঁড়াইয়া কুচো মাছ ধরিতাম। শুকনো কাঠি লইয়া জলে ভাসাইয়া উহাকে বড় ভোঁওয়ালা জাহাজ কল্পনা করিতাম।
পৌষ আসিত, সংক্রান্তির দিনে সাধনের মা পিঠাপুলি বানাইয়া আমায় ডাকিয়া পাঠাইত। হস্তে পিঠা লইয়া ঘরে ফিরিবার সময় আমি ভাইবোনের ভাগ কমাইবার উদ্দেশ্যে নদীর ধারে গিয়া বসিতাম। আমার আর কুনুড়ের কত সুখদুঃখের কথা হইত। ভাগের পিঠা হইতে নদীর মাছগুলাকেও ভাগ দিয়াছি কত বার।
পৌষ সংক্রান্তির দিনে অতি প্রত্যুষে, দিনের আলো ফুটিবার পূর্বেই, হিঁদু মেয়েরা ঘাটে আসিত, বাড়ির কর্ত্রীরা একখানা হুলা লইয়া তাহাতে ধানদুব্বা আর সরিষার দানা ভরিয়া উপরে একখানি ছোট্ট প্রদীপ জ্বালাইয়া ভাসাইয়া দিতেন কুনুড়ের জলে। পৌষকে বড্ড ভালোবাসিতাম আমরা। কুলবধূরা পৌষের ভোরে কনকনে জলে অবগাহন করিয়া নদীর পাড়েই কাঠকুটা দিয়া আগুন পোহাইত। আগুনের চারিধারে বসিয়া গান গাহিত,
"এসো পৌষ, যেয়ো না
জনম জনম ছাড়িব না।"
হিঁদু ঘাটে বিবাহোত্তর কিছু অনুষ্ঠান হইত। একখানি কাঁসার থালা লইয়া বধূ আর বরের মধ্যে খেলা চলিত। এক হাঁটু জলে দাঁড়াইয়া, বধূ থালা জলের তলা দিয়া কোথাও ছুড়িয়া দিত, বর নদীবক্ষ হইতে উহা খুঁজিয়া আনিত। কখনও কখনও বর ছুড়িত আর বধূ খুঁজিয়া আনিত।
আমরা নদী তীরবর্তী গাছগুলার ডালে বসিয়া নবদম্পতির খেলা দেখিতাম আর কল্পনা করিতাম, আমরাও বিবাহ করিয়া বরকে এই খেলায় কী ভাবে পর্যুদস্ত করিব। ক্ষুদ্র মস্তকে ইহা ঢুকে নাই, আমি মুসলমানের মেয়ে। আরব হইতে আসা ধর্ম। নবির ভালবাসা আছে। নদীর ভালবাসা আমার মাজহাবে নাই। বিবাহ হইয়া গেল। আমার কুনুড় ছাড়িয়া লালমাটির এক রুক্ষ দেশে আসিয়া পড়িলাম। সেখানে পুকুর খুঁজিলে লোকে ডোবা দেখাইয়া দেয়।
আমার পতিগৃহে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, নদী ছিল না। মাছ খাইতাম বিস্তর। কিন্তু জল বহিত না। সব ছাড়িয়া-ছুড়িয়া মনের একখানা দগদগে ঘা লইয়া যখন পিত্রালয়ে ফিরিলাম, তখন দীর্ঘ সপ্তবিংশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। মাস চার-পাঁচেক পরে যখন তপ্ত হৃদয় চোখের জলেও শীতল হইল না, আমার বাল্যসখী কুনুড়ের পার্শ্বে যাইয়া বসিলাম। আমার সখীকে দেখিয়া বড্ড কষ্ট হইল। রুগ্ন শীর্ন জিরজিরে শরীর লইয়া কোনো রকমে বহিয়া চলিয়াছে। কোথায় সে তরঙ্গ, কোথায় সে মৎসদলের রূপালি ঝিকিমিকি। হিঁদু ঘাট আর মুসলমান ঘাট দুটাই বিলীন হইয়াছে। এখন দুই পাড়ায় ঘরে ঘরে পাম্প বসিয়াছে।
শুধাইলাম, নদী, তোমার কি হইয়াছে? আমার কুনুড় বড্ড ক্ষীণকন্ঠে জবাব দিল, আর কেহ আসে না। আমার প্রয়োজন ফুরাইয়াছে। আমি যাইতেছি।