OTT Platforms

স্টিভেন স্পিলবার্গও কি ওটিটি-তেই মজে থাকতেন!

একা ছবি দেখার জেরে ছবি ফেলে রাখতে চাননি অনেক প্রযোজক। ছবি রেখে দেওয়ার জায়গায় ওটিটি-র মাধ্যমে  কিছু টাকা ঘরে তোলা জরুরি বলে মনে করেছেন নির্মাতারা।

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৩৩
Share:

২০২০-র বিনোদন দুনিয়া নতুন করে চিনিয়ে দিয়েছে ওটিটি-কে।

বিকেল পড়ে আসছে। শীতের বিকেলে একটাও খদ্দের জোটেনি সিধুর। কী করেই বা জুটবে? ‘বই’ হিট হলে ঝালমুড়ির বিক্কিরি বাড়ে। সিনেমাহলে লোক নেই। ছবি আছে। সিধু ভাবছে নতুন বছর থেকে অন্য ব্যবসা করবে। “এ ঠিক হওয়ার নয়। দেখুন হলের গেটে মাকড়সারা কেমন জাল বুনেছে!” ২০২০-র করোনা ভাইরাসে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সিঙ্গল স্ক্রিন।

Advertisement

বিয়ের পর থেকে রবিবার মানেই নিয়ম করে পপকর্ন আর সিনেমা হল। কর্পোরেট সেক্টরের দাম্পত্যের ক্যানভাস বদলে গেল ২০২০-তে। বাড়ি ফিরে ‘সুখী’ দম্পতি যে যার ঘরে মোবাইলে এখন একা একা সিরিজ দেখে। ছবির দুনিয়ায় মুছে গিয়েছে ‘কমিউনিটি ভিউয়িং’। ২০২০-র বিনোদন দুনিয়া নতুন করে চিনিয়ে দিয়েছে ওটিটি-কে। এক ধাপে প্রায় ২০০ শতাংশ ওটিটি ভিউয়িং বেড়ে গিয়েছে। এ বছরের বিনোদন দেখিয়ে দিল, টেলিভিশন কী করে আবার ইন্ডাস্ট্রির মানুষের জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে পারে। যেহেতু দর্শক সিনেমাহলে আসছেন না, তাই প্রোডাকশন হাউসগুলো এখন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মেরই মুখাপেক্ষী। ভাবনাটা এমন যে, পাশাপাশি বসে মজা করে যদি সিনেমা দেখা না যায়, তবে বাড়িতে বসে ওয়াইফাই দিয়ে সিনেমা দেখব।

সিনেমা তো আসলে একটা অভিজ্ঞতা। সকলের সঙ্গে দেখা। মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া। করোনা যেন নিঃশব্দ আততায়ীর মতো মতো বিনোদনের দুনিয়াকে শেষ করে দিল।

Advertisement

প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির অপেক্ষায় না থেকে বেশ কিছু ছবি ওটিটি-তে আসে।

একা ছবি দেখার জেরে ছবি ফেলে রাখতে চাননি অনেক প্রযোজক। ছবি রেখে দেওয়ার জায়গায় ওটিটি-র মাধ্যমে কিছু টাকা ঘরে তোলা জরুরি বলে মনে করেছেন নির্মাতারা। যেমন বিগ স্টারকে নিয়ে বাজি লড়েছিলেন সুজিত সরকার। অমিতাভ বচ্চনের ‘গুলাবো সিতাবো’ ওটিটি-তে মুক্তি পেলেও তেমন সাফল্য আনতে পারেনি। আনন্দবাজার ডিজিটালকে সুজিত সরকার বলেছিলেন, “এই ছবি বক্স অফিস আমাকে বানাতেই দিত না। আসলে ছবির ‘পেস’ নিয়ে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং একেবারেই আলাদা। বক্স অফিস নয়, ক্রাফ্টের দিক থেকে আমার ছবিকে দেখি আমি। ‘পিকু’ জনপ্রিয়। যেমন ‘ভিকি ডোনার’। আমি তো বলছি না, ওই ছবিগুলো আমি বানাইনি! আমি শিল্প নিয়ে না ভাবলে পরের ছবির কথা ভাবব কী করে? এই যে বললাম, এখন লোকে ‘অক্টোবর’ দেখছে। তা হলে?” ঠিকই। সিনেমাহলে কম চলা সুজিতে ‘অক্টোবর’ এ বছর ওটিটি-তে দর্শকেরা অনেক বেশি দেখেছেন।

‘বন্দিশ ব্যান্ডিটস’ মিউজিক্যাল সিরিজে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নাসিরউদ্দিন শাহ। ওটিটি-তে সেই সিরিজের মুক্তি প্রসঙ্গে তিনি মুম্বইয়ের সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবি রিলিজ় করার স্বাধীনতা রয়েছে। প্রযোজক, ডিস্ট্রিবিউটর কিংবা স্টারদের কাছ থেকে পরিচালককে অহেতুক পরামর্শ নিতে হবে না। আমাদের এটা মাথায় রেখেই ভবিষ্যতে চলতে হবে যে, একদিন সিনেমাহল ব্যাপারটা না-ও থাকতে পারে।’’ সলমন খানের ছবি ওটিটি-তে মুক্তি পেলে দর্শকের প্রতিক্রিয়া কী রকম হবে, তা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে নাসিরের।

বলিউড ওটিটি নিয়ে সাবালক হলেও টলিউড ওটিটি নিয়ে খুব বেশি এগোয়নি। ২০২০-তে ইতিমধ্যেই খান চল্লিশেক বাংলা ছবি মুক্তির অপেক্ষায়। কিন্তু হল খুলছে না। তবুও ওটিটি-তে তাদের দেখা মিলল না কেন? পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “সিংহভাগ জুড়ে বিনোদন দুনিয়ার কেন্দ্রে এ বছর ওটিটি। তবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের প্রাধান্য বেশি ছিল। এখনও পর্যন্ত বাংলায় ওটিটি-তে এমন কোনও শো তৈরি হয়নি, যা মনে রাখার মতো। ‘কণ্ঠ’ ওটিটি-তে জনপ্রিয় হয়েছে।” শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায়ের ‘বেলাশুরু’ মুক্তির জন্য সিনেমা হল খোলার অপেক্ষায় থাকলেও এ বছর লকডাউনে বিজ্ঞাপনের কাজ করে নিজেদের কাজের আঙ্গিক বদলে ফেলেছেন পরিচালকদ্বয়। করোনা-কালে অ্যামাজন প্রাইম, হটস্টার থেকে নেটফ্লিক্স— কোথাও কোনও বাংলা ছবির প্রিমিয়ার হতে দেখা যায়নি। সাম্প্রতিককালে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যে দু’টি ছবি মুক্তি পেয়েছে, সেগুলি হল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নিরন্তর’ এবং রাজা চন্দর ‘হারানো প্রাপ্তি’। দু’টি ছবির ক্ষেত্রেই উপগ্রহ স্বত্ত্ব অনেক দিন আগে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির অপেক্ষায় না থেকে ছবিগুলি ওটিটি-তে আসে। কিছু দিন আগে প্রসেনজিৎ বলেছিলেন, ‘‘জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন ট্যালেন্টদের জন্য ওটিটি নিঃসন্দেহে একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। আমরা এখন খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তবু বলব, সিনেমাহলের যে ম্যাজিক, সেটা অন্তত আরও ১০০ বছর থেকে যাবে!’’

পাশাপাশি বসে যদি সিনেমা দেখা না যায়, তবে বাড়িতে ওয়াইফাই দিয়ে সিনেমা দেখাই পছন্দ অনেকের।

তথ্য এবং ইতিহাস বলছে, বক্স অফিসে সফল বাংলা ছবি প্রথমেই ওটিটি-তে আসেনি। আসবে, অচিরে এমন সম্ভাবনাও নেই। বলিউডের নিরিখে টলিউডকে দেখলে খানিকটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। যেমন সলমন খানের ৩০০ কোটি ক্লাবের কোনও ছবি ওটিটি-তে মুক্তি পায়নি। অভিজ্ঞরা বলছেন, বলিউডের সে সব ছবিই ওটিটি-তে মুক্তি পেয়েছে, যেগুলির ‘ব্লকবাস্টার’ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। যেমন, ‘গুলাবো সীতাবো’ ৪০-৪৫ কোটি টাকার ছবি। যা অ্যামাজন কিনেছিল ৬০ কোটিতে। অর্থাৎ, প্রযোজকের ঘরে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা এসেছিল। উপগ্রহ স্বত্ত্ব বাবদে টাকা বাদ দিয়েও। সুশান্ত সিংহ রাজপুত-অধ্যায়ের পরবর্তী ‘সড়ক ২’ হল-এ মুক্তি পেলে মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। সেখানে হটস্টার ৪০ কোটি টাকার ছবিটি ৬০ কোটি টাকায় কিনেছে। ওটিটি থেকে সুশান্তের শেষ ছবি ‘দিল বেচারা’-র বক্স অফিস সংগ্রহই হয়েছে ২,০০০ কোটির কাছাকাছি।

এসভিএফ-এর অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনির অবশ্য বক্তব্য, বাংলা ছবি এখনও দুনিয়া জুড়ে চর্চিত। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলা ছবি যাওয়া নিয়ে তাঁর সাফ কথা, “কোনও বড় বাজেটের বাংলা ছবির প্রিমিয়ার ওটিটি-তে হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ওটিটি বাংলা ছবির ডিজিটাল প্রিমিয়ারের জন্য যে পরিমাণ টাকা দেয়, তা থেকে ছবির খরচের ২০ শতাংশও ওঠে না!” এসভিএফ তাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’-এর জন্য ‘ডিটেকটিভ’, ‘তাসের ঘর’-এর মতো ছবি তৈরি করলেও ‘গোলন্দাজ’ বা ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর মতো বড় বাজেটের ছবি যে সিনেমাহলেই রিলিজ করবে, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। শেষ কুড়ি বছরে কোনও বাংলা ছবি দিয়ে বার্লিন বা কান ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন হয়নি। অন্য দিকে, এমন বাংলা ছবিও হয়নি, যে দ্যাখ-দ্যাখ করে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা দিয়েছে। কোভিডে জড়ানো বছরে বাংলা বিনোদনের ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বাংলার বিনোদন দুয়োরানি হয়ে থাকলেও হলিউডে ক্রিস্টোফার নোলানই একমাত্র পরিচালক, যিনি করোনার মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে তাঁর ছবি ‘টেনেট’ প্রেক্ষাগৃহে রিলিজ করেছেন। ওটিটি-তে ছবি দেওয়ার বদলে যে দেশে যখন সিনেমাহল খুলেছে, সেখানে ছবি রিলিজ করিয়েছেন। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রযোজনা ‘টেনেট’, যারা কিছু দিন আগেই ঘোষণা করেছে, ২০২১ সালে তাদের সব ছবি সিনেমাহলের পাশাপাশি একই দিনে ম্যাক্স-এও (ওটিটি) দেখা যাবে। প্রযোজনা সংস্থার সেই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে নোলান বলেছেন, ‘‘এটা অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা, যা কাউকে না জানিয়েই ঘটানো হয়েছে। এই স্টুডিয়োয় ভাল পরিচালক, তারকারা কাজ করেন। তাঁরা আশা করেন, তাঁদের কাজ বড় পর্দায় দর্শক দেখতে পারবেন। আলোচনা না করেই ওটিটি-তে ছবি দেওয়া মূর্খের কাজ।’’

আরও পড়ুন: ভেঙে যায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সানি বিবাহিত জেনে নিজেকে প্রতারিত মনে হয়েছিল অমৃতার

ছবি রেখে দেওয়ার জায়গায় ওটিটি-র মাধ্যমে কিছু টাকা ঘরে তোলা জরুরি বলে মনে করেছেন নির্মাতারা।

যা যা সিনেমায় দেখা যাচ্ছে না, তা খুব সহজে ওটিটিতে দেখানো যাচ্ছে। পরিচালক অরিন্দম শীল বললেন, “আমি ‘টেনেট’ দেখতে গিয়ে দেখলাম সিনেমাহলে যথেষ্ট লোক। ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ দেখার জন্য তো হল ভর্তি। বলা যেতে পারে ২০২০ সালে ওটিটি আমাদের সাপোর্ট দিল। আমাদের একাকিত্বে ডিজিটাল কনটেন্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ভিন্ন ফর্মের জন্য মানুষ কনটেন্ট ক্রিয়েট করে বেঁচে রইল। মিউজিক ভিডিয়ো থেকে কর্পোরেট ফিল্ম— এত আঙ্গিকে কাজ করলাম। এটাই আমার পাওয়া।” এ বছর বিনোদন জগৎ কিছু পেল বলে মনে করছেন না পরিচালক শৈবাল মিত্র। তাঁর কথায়, “বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত মানুষ যে সবচেয়ে অবহেলিত, বুঝিয়ে দিল এই সময়। সিনেমা হলে আলো দেখানো মানুষদের খবর আমরা ক’জন রাখতে পেরেছি। আমরা না খেতে পেয়ে মরে গেলেও কারও কিছু যায় আসে না!”

স্টিভেন স্পিলবার্গ বলেছিলেন, ‘‘সিনেমা মানুষকে আশা জোগায়। যাতে সে পরের দিনের লড়াইটা করতে পারে।’’ ২০২০ সালে ঘরের একলা মোবাইল স্ক্রিনে আটক দর্শকের জন্য কী বলবেন স্পিলবার্গ!

আরও পড়ুন: দশঘড়ায় রুক্মিণী, সেটেই কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন ‘মহা’ দেবের

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement