নুসরত।
হেনস্থার সঙ্গে নারীদের নিত্যদিনের বাস। বাড়ি, কর্মস্থল, বাস-ট্রাম ছাপিয়ে গত কয়েক বছরে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম নারীদের ত্রাসের তালিকায় নতুন সংযোজন। মহিলা সেলেব্রিটির প্রতি আক্রোশ মেটানোর সবচেয়ে সহজ পথ, তাঁকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া। এখনও দেশের প্রতিটি শহরে সাইবার-অপরাধের বিরুদ্ধে আইন পোক্ত না হওয়ায় এই সুযোগ ক্রমাগত কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। অতিমারি পরিস্থিতিতে বাইরে বেরোনো নিয়ন্ত্রিত হওয়ায়, অনলাইনে হেনস্থার পরিসংখ্যান বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
সম্প্রতি এই হেনস্থার শিকার হয়েছেন অভিনেত্রী-পরিচালক পূজা ভট্ট। তাঁর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে ধর্ষণ ও খুনের লাগাতার হুমকি আসায় তিনি প্রোফাইল ‘প্রাইভেট’ করে দিয়েছেন। অনুরাগীদের জানিয়েছেন, তাঁর আপডেট পেতে প্রোফাইলে ‘রিকোয়েস্ট’ পাঠাতে। অনেক দিন পরে বড় পর্দায় ফিরছেন পূজা, ‘সড়ক টু’র হাত ধরে। নিশানায় তিনি একা নন, আছে তাঁর বোন আলিয়া, শাহিন ভট্টও। ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে ধর্ষণের হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন শাহিন। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু এবং তার জেরে নেপোটিজ়ম বিতর্কের কারণে নেটিজ়েনদের চক্ষুশূল ভট্ট পরিবারের কন্যারা।
এ দিকে সুশান্তের মৃত্যুর পর থেকেই ভার্চুয়াল কাঠগড়ায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে রিয়া চক্রবর্তীকে। সুশান্তের মৃত্যুর এক মাস পরে তিনি ইনস্টাগ্রামে হুমকি-চ্যাটের স্ক্রিনশট পোস্ট করেছিলেন। মুম্বই পুলিশের সাইবার শাখাকে ট্যাগ করে পদক্ষেপ করার আর্জি জানিয়েছিলেন রিয়া। দু’টি প্রোফাইল চিহ্নিত করেছিল মুম্বই পুলিশ। তবে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
অনলাইন নীতি-পুলিশি ও ট্রোলিংয়ের সঙ্গে ছোট-বড় সব মাপের সেলেবই কম-বেশি পরিচিত। কিন্তু ধর্ষণ ও খুনের মতো হুমকি দিয়ে যখন কোনও সেলেবকে অপদস্থ করার চেষ্টা করা হয়, তখন আর হালকা ভাবে নেওয়ার জায়গা থাকে না। পূজা ও রিয়া এই ট্রেন্ডের সাম্প্রতিক উদাহরণমাত্র।
রিয়া।
হেনস্থার ছবি টলিউড-বলিউডে প্রায় একই রকম। নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন মডেল-অভিনেত্রী ঊষসী সেনগুপ্ত। একটি অ্যাপ-ক্যাবে তাঁর চালককে মারধর করা ও তাঁকে হেনস্থা করার অভিজ্ঞতা সোশ্যাল মিডিয়ায় স্পষ্ট ভাবে লিখেছিলেন তিনি। ‘‘লক্ষ করে দেখবেন, যে কোনও ভাষার গালিগালাজে মা-বোনেদের ছোট করা হয় বেশি। আর অনলাইনে কাউকে তো দায় নিতে হয় না। তাই মানসিক হেনস্থা করাটা খুব সহজ।’’ ঊষসীর মতে, নারীদের এত রকম পরিস্থিতি সহ্য করতে হয় যে, তাঁরা সব সময়ে প্রতিবাদ করতে পারেন না। ‘‘লকডাউনের মধ্যে একদিন লাইভ ভিডিয়ো করছিলাম। আমার ভাইও ছিল সেখানে। এক ব্যক্তি ক্রমাগত অশালীন মন্তব্য করে যাচ্ছে। ভাই খুব রেগে যাচ্ছিল। কিন্তু আমিই ইগনোর করলাম,’’ বললেন ঊষসী। ভার্চুয়ালি চরম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় কষ্ট পান অভিনেত্রী। ‘‘সঙ্গে সঙ্গে কমেন্ট ডিলিট করি। আমার মনে হয়, সব মহিলাই এতে কম-বেশি বিপর্যস্ত হন,’’ বক্তব্য তাঁর।
পর্দায় অবাধ শরীর প্রদর্শনের কারণে, ছবির কনটেন্ট প্রসঙ্গে বা কোনও আলটপকা মন্তব্যের জেরে অভিনেত্রীদের হুমকির মুখে পড়া এক ধরনের। কিন্তু প্রশ্ন যখন ধর্ম বা রাজনীতির মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলি ঘিরে চলে, তখন এই আক্রমণ আরও বিভীষিকার আকার নেয়। ‘পদ্মাবত’ ছবি মুক্তির আগে রাজপুত ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে ধর্ষণ থেকে মুণ্ডচ্ছেদ... কোনও হুমকি থেকে বাদ যাননি দীপিকা পাড়ুকোন। নির্দিষ্ট এক রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতা করায় প্রায়শই টুইটারে ধর্ষণের হুমকি পান স্বরা ভাস্কর। আবার কোনও পুরুষ সেলেব্রিটিকে ছোট করার জন্য তাঁর বাড়ির মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়ে থাকে। মেয়ে আলিয়াকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পরেই কিছু দিনের জন্য টুইটার অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করেছিলেন পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ।
পূজা।
অভিনেত্রী-সাংসদ নুসরত জাহান যখনই কোনও হিন্দু অনুষ্ঠানে শামিল হন, তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন। পাশাপাশি ভার্চুয়ালিও চলতে থাকে হুমকি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা খোলসা করতে না চাইলেও অভিনেত্রীর বক্তব্য, ‘‘অনলাইনে যারা ধর্ষণ বা খুনের হুমকি দেয়, তারা বিকৃত মানসিকতার মানুষ। জীবনে কোনও রকম নেগেটিভিটিকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। অনলাইনে এই বাড়বাড়ন্ত নিয়ে আমি চিন্তিত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি বিভ্রান্ত হই না।’’
তর্কের খাতিরে, কোনও মহিলা সেলেব যদি দোষী প্রমাণিতও হন, তবুও তাঁকে ভার্চুয়ালি হেনস্থা করার অধিকার বর্তায় না। স্পষ্টবক্তা হওয়ার জন্য অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতকেও নানা ভাবে অনলাইন হুমকির মুখে পড়তে হয়।
এই অন্যায়ের মোকাবিলা করতে সদর্থক পদক্ষেপ করেছেন সোনাক্ষী সিংহ। গত ১৪ অগস্ট মুম্বইয়ের অপরাধ দমন শাখায় এক ব্যক্তির (যিনি ইনস্টাগ্রামে হুমকি দিয়েছিলেন অভিনেত্রীকে) বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন সোনাক্ষী। ছ’দিন পরে ঔরঙ্গাবাদ থেকে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। অনলাইন হেনস্থার বিরুদ্ধে সোনাক্ষীর ক্যাম্পেন, ‘অব বাস!’ সাইবার আইন মজবুত ও কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে আওয়াজ তুলছেন অভিনেত্রীরা।