সৌমিত্র এবং অনির্বাণ।
অনেকে বলেন, অভিনয় জগতে প্রবেশের পথ নাটক। মঞ্চের হাসিকান্নায় দর্শকের হাততালি পাওয়ার যে রোমাঞ্চ, তা নেশা তৈরি করে। প্রত্যেকটা শোয়ে ভাল থেকে আরও ভাল অভিনয় তৈরি করে এক-একটা মাইলফলক। শিশির ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, উৎপল দত্ত, জোছন দস্তিদারের হাত ধরে মঞ্চ থেকে বড় পর্দায় উঠে এসেছেন কত অভিনেতা, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই এখন তারকা। আর সেখানেই বদলে যাচ্ছে অভিনয়ের জগৎ।
চিরকালই মঞ্চ আর পর্দার মধ্যে একটা ব্যবধান থেকে গিয়েছে। রেললাইনের মতো দুইয়েরই পাশাপাশি সহাবস্থান। তবুও একে অপরের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে।
নাটক থেকে সিনেমায় এসেছেন, এমন শিল্পীর নাম প্রচুর। কিন্তু সিনেমা থেকে মঞ্চে কত জনই বা ফেরত যান?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। তিনি সিনেমা দিয়ে শুরু করলেও ফিরে আসেন নাটকে। ‘‘থিয়েটার আমার ফার্স্ট লাভ। তবে পেশা হিসেবে সিনেমা দিয়ে শুরু। কিন্তু ছবি করার এক দশকের মধ্যেই থিয়েটার শুরু করি। তার পর থেকে অভিনয়টা করে গিয়েছি, তা সে মঞ্চ হোক বা পর্দা। কোনও অসুবিধে হয়নি কখনও,’’ বললেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কয়েক বছর আগেও তাঁর ‘রাজা লিয়ার’ নাটক চলাকালীন লম্বা লাইন প়ড়েছে, টিকিট ব্ল্যাকও হয়েছে।
তা হলে এখন যাঁরা নাটক থেকে ছবিতে আসছেন, তাঁরা আর মঞ্চে ফিরে যাচ্ছেন না কেন? সৌমিত্র বললেন, ‘‘পুরোটাই হয়তো কেরিয়ার গড়ার জন্য। এখন তো অনেকে সিরিয়াল করেই সন্তুষ্ট। সিরিয়ালে অভিনয় করাই তাদের লক্ষ্য।’’
নাটক দিয়ে অভিনয় জগতে পদার্পণ শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়েরও। চার্বাকে নাটক শিখেছিলেন প্রায় ছ’বছর। সেখান থেকে বিশ্বরূপা থিয়েটার। শেষ নাটক ‘বৈশাখী ঝড়’। কিন্তু পর্দায় আসার পরে আর তাঁর ফিরে যাওয়া হয়নি মঞ্চে। শাশ্বত বললেন, ‘‘নাটক তো লাইভ। ভাল দৃশ্যে দর্শকের হাততালি পাওয়ার একটা নেশা আছে। কিন্তু যখন একটা মানুষের উপর তাঁর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে, তখন যদি নিশ্চিত রোজগারের উপায় থাকে, তবেই নেশা আর পেশাকে যোগ করা যায়।’’
শুধু মাত্র অর্থনৈতিক কারণেই কি এই পথ পরিবর্তন? রোজগারের উপরেই হয়তো পুরো দায় চাপিয়ে দেওয়া যায় না। শাশ্বত যে বার প্রথম বেস্ট ডেবিউ পুরস্কার পান, সোজা চলে গিয়েছিলেন জোছন দস্তিদারের বাড়িতে। তখন তিনি রোগশয্যায়। কিন্তু সেই সময়েও শাশ্বতকে মঞ্চে ফিরে আসতে বলেছিলেন তিনি। শাশ্বত বলেছিলেন, ‘‘নাটক করতে হলে রিহার্সাল করা উচিত। রিহার্সাল করার সময় নেই। মহড়ায় এক জন আমার হয়ে প্রক্সি দেবে আর আমি গিয়ে সোজা শো করব, সেটা আমার কখনও ঠিক মনে হয় না!’’ উত্তরে জোছন বলেছিলেন, ‘‘বড্ড পেকেছিস তুই।’’ কিন্তু এখনও সেই কথাটা মেনে চলেন শাশ্বত। ‘‘রিহার্সাল করার সময় যখন পাব, নিশ্চয়ই ফিরব মঞ্চে,’’ কথা দিলেন দর্শককে।
অন্য দিকে অনির্বাণ ভট্টাচার্য। যাঁর এক ঝুলিতে ‘রাজা লিয়ার’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘অদ্য শেষ রজনী’র মতো নাটক, তো অন্য দিকে রয়েছে ‘ঈগলের চোখ’, ‘আলিনগরের গোলকধাঁধা’, ‘উমা’র মতো ছবি। কিন্তু বছর দুয়েক হল তিনিও আর নতুন কোনও নাটক করছেন না। যে নাটকের শো চলছে, সেখানেই তাঁকে দেখা যাচ্ছে। অনির্বাণের কথায়, ‘‘যে শোগুলো চলছে, তার জন্য খুব একটা অসুবিধে নেই। কিন্তু নতুন নাটক করার মতো সময় নেই।’’
সিরিয়ালের জগতেও এ রকম অনেক মুখ দেখা যাচ্ছে, যাঁরা থিয়েটার থেকে সিনেমার জগতে চলে এলেও আর ফিরে যাননি মঞ্চে। পর্দার দিকে যাওয়া এই একমুখী স্রোতের কারণ কী? অনির্বাণের উত্তর, ‘‘কারণটা খুব পরিষ্কার, টাকা। আর একটা কারণ হতে পারে অভিনেতার আত্মসন্তুষ্টি। কেউ হয়তো পর্দার অভিনেতা হিসেবে নিজেকে দেখতে চান। আবার কেউ হয়তো সিনেমা বা সিরিয়ালে অভিনয় করে সন্তুষ্ট নন, তিনি আবার ফিরে যান মঞ্চে।’’
মঞ্চ যেন বিদ্যালয়ের মতো ভিত তৈরি করে দেয় পড়ুয়াদের। আর পর্দা হয়ে উঠেছে তাদের কর্মক্ষেত্র। কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ক’জন আর সময় পায় সেই স্কুলের মাটিতে ফিরে যাওয়ার! দিনের শেষে, স্কুলের পড়া যেন জীবনের পাথেয় হয়, সেটাই কাম্য। ঠিক তেমনই মঞ্চ এবং পর্দা ছাপিয়ে বেঁচে থাকুক অভিনয়, তা-ই যেন হয় এক জন সফল অভিনেতার সেরা প্রাপ্তি।