গুলাবো সিতাবো-শকুন্তলাদেবী
বিপদের দিনে হাতে হাত রেখে পাশে থাকাটাই দস্তুর। কিন্তু বাস্তব সব সময়ে সরলরেখায় চলে না। সিনেমা রিলিজ়ের মাধ্যমকে কেন্দ্র করে প্রযোজক এবং এগজ়িবিটরদের দ্বন্দ্ব সে কথাটাই স্পষ্ট করে দিল। লকডাউনের জেরে সম্প্রতি বেশ কিছু প্রযোজক তাঁদের ছবি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘গুলাবো সিতাবো’, ‘শকুন্তলাদেবী’-সহ সাতটি ছবি অ্যামাজ়ন প্রাইমে আসছে। প্রযোজকদের এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট এগজ়িবিটর মহল। মাল্টিপ্লেক্স এবং সিঙ্গল স্ক্রিন দু’তরফেই আপত্তি উঠেছে। আইনক্স, পিভিআর-এর মতো সংস্থা কড়া ভাষায় প্রযোজকদের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। আর তাতে প্রযোজকেরা আরও ক্ষিপ্ত হয়েছেন। সিনেমা হলে দর্শক সমাগম না হওয়া পর্যন্ত ওটিটি-তে ছবি রিলিজ়ের প্রবণতা চলতে থাকবে। এই তরজাও কি তত দিন চলবে?
এই লকডাউনের পরিস্থিতিতে সকলেই চাইছেন নিজের ব্যবসা বাঁচাতে। ওটিটি বনাম সিনেমা হল ডিবেটের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণ জোহর বলেছেন, ‘‘সকলে ভাবছেন প্রযোজকদের অনেক টাকা। আমাদের কিন্তু পুরোটাই রোটেশন মানি। একটার লাভ আর একটায় বিনিয়োগ করতে হয়। পাশাপাশি প্রোডাকশন সেটআপ বজায় রাখতে হয়, কর্মীদের মাইনে দিতে হয়। সেই পরিস্থিতিতে কোনও প্রযোজক যদি মনে করেন ওটিটি-তে ছবি বিক্রি করে তিনি লাভবান হবেন, তাতে দোষের কিছু নেই।’’ এ দিকে সেটআপ এবং কর্মীদের মাইনে দেওয়ার যুক্তি এগজ়িবিটরাও দিচ্ছেন। কর্ণের বার্তা, ‘‘সব কিছু স্বাভাবিক হলে সিনেমা হলই প্রাধান্য পাবে। পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু হয়ে গেলে মাঝপথে থাকা ছবিগুলো তৈরি হয়ে যাবে।’’ আর তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন, সিনেম্যাটিক এক্সপিরিয়েন্সের জন্য তৈরি ছবি সিনেমা হলে রিলিজ় করাই উচিত।
একই অবস্থা বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতেও। কাজ বন্ধ থাকলেও, বন্ধ দরজার পিছনে এজেন্টদের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্স এবং প্রেজ়েন্টেশনে ব্যস্ত টলিউড। কোন ছবি অনলাইন রিলিজ় হচ্ছে, তার চূড়ান্ত ঘোষণা না হলেও, অনেকেই লেনদেন পাকা করে নিচ্ছেন। কেউ আবার ছবির দর বাড়ানোর জন্য সময় নিচ্ছেন। কারণ যত দিন গড়াবে, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবির চাহিদা বাড়বে। প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ-এর অন্যতম কর্ণধার মহেন্দ্র সোনির বক্তব্য, ‘‘প্রযোজক হিসেবে তো বটেই সিনেমা-প্রেমী হিসেবেও বড় পর্দা আমার কাছে বেশি প্রাধান্য পাবে। তবে এই সময়টা আমরা আগে কেউ প্রত্যক্ষ করিনি। তাই এত জটিলতা তৈরি হচ্ছে। যাঁরা অনলাইনে ছবি দিচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বাধ্য হয়েই দিয়েছেন। আমার মতে, বড় কোনও বাংলা ছবি ওটিটি রিলিজ় হবে না। কারণ যে টাকার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, তাতে প্রোডাকশনের খরচই উঠবে না।’’
বড় পর্দা না অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালকদের ভোট কোন দিকে? বলিউডের মতো টলিউডও দু’টি শিবিরে বিভক্ত। রাজ চক্রবর্তী যেমন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায়। তাঁর যুক্তি, ‘‘যে সিনেমা হলের জোরে আমরা এত দিন চালালাম, তাদের থেকে এখন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া অনুচিত।’’ আবার পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে কেউ অনলাইন রিলিজ় করে লাভ করতে চাইতেই পারে। তবে আমার কাছে সিনেমা মানে বড় পর্দা।’’ তাঁর পরিচালিত ‘বনি’ বা ‘অভিযান’ অনলাইন রিলিজ়ের কথা ভাবছেন না। কিন্তু তাঁর অভিনীত বেশ কিছু ছবি, যেগুলো তুলনামূলক ছোট প্রযোজনা সংস্থার, সেগুলো ওটিটি রিলিজ়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানালেন পরমব্রত।
আপৎকালীন পরিস্থিতির কারণে অনলাইন রিলিজ় হচ্ছে, এই যুক্তিতে আপত্তি আছে এগজ়িবিটর-ডিস্ট্রিবিউটর শতদীপ সাহার। পাঁচ মাস আগে ‘গুলোবো সিতাবো’র ডিস্ট্রিবিউশন রাইট কিনেছিলেন তিনি। ইন্টারেস্ট-সহ টাকা ফেরতের দাবি জানিয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা, অনলাইন রিলিজ়ের এই ট্রেন্ডের ফলে সিনেমা হল খুললেও তাদের হাতে দেখানোর মতো ছবি তখন থাকবে না। হল খুলে গেলে বড় রিলিজ়ের চাপে কি ছোট ছবিগুলোকে এগজ়িবিটররা জায়গা দিতে পারবেন? এ আশঙ্কাও কিন্তু রয়েছে। ‘‘এক মাস পরে হল খোলার অনুমতি দেওয়া হলে আমরা কোনও ছবি দেখাতে পারব না। কারণ পরিস্থিতি একদম স্বাভাবিক না হলে বড় বাজেটের ছবি মুক্তি পাবে না। সে ক্ষেত্রে ভরসা ছিল ছোট বাজেটের ছবিগুলো। আর সেগুলোই এখন ডিজিটালে রিলিজ় হয়ে যাচ্ছে। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন রিলিজ়ের সপক্ষে মত দিচ্ছেন অনেকে। এটা বিপদের দিনে একে অপরের পাশে থাকার বদলে নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া আর কিছু না,’’ মন্তব্য শতদীপের।
যে দু’পক্ষ এত দিন জোট বেঁধে কাজ করত, তারাই এখন যুযুধান।
আরও পড়ুন: কায়দা জারি কোয়রান্টিনেও