West Bengal Lockdown

খাবারের জন্য মানুষ ছুটছে, এর পরেও খাওয়া নিয়ে বড়াই: অরিন্দম শীল

লকডাউনের জীবন ভিন্নতর অর্থ নিয়ে আসছে। ডায়েরির পাতায় মগ্ন অরিন্দম শীল‘কোনওদিন খুব বেশি খাওয়ার থাকে না আমার। সকালে ঘুম ভাঙলেই ছোটার থাকে। শুট, অফিস...এখন শান্তি।’

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২০ ১৮:১৭
Share:

অন্তরাল আরও অনেক অচেনাকে চিনিয়ে দেয়। অরিন্দম শীল।

সকাল সাড়ে ৮টা

Advertisement

বেশ কিছুক্ষণ আগে ভোর পেরিয়ে গিয়েছে। কাল প্রায় ৩টে হয়ে গেল শুতে শুতে। এখন সকাল সাড়ে ৮টা। মুর্গিটা ডেকেই চলেছে। কিআশ্চর্য! আমার ৪৪তলা ফ্ল্যাটে অত নীচের কোন অঞ্চলের ডাক ভেসে আসছে! এ অন্য কলকাতা। শুধু পাখির আওয়াজ। হর্নের আওয়াজ নেই। তবে এই করোনা মানুষের থেকে মানুষকে দূরে করল আর আমাদের শেখাল, লাল বাতি, নীল বাতি, সেলিব্রিটি, গরিব, ধনী সকলের কাছেই সমান। এ কাউকে ছাড় দেবে না।

সকাল ৯টা

Advertisement

কোনওদিন খুব বেশি খাওয়ার থাকে না আমার। সকালে ঘুম ভাঙলেই ছোটার থাকে। শুট, অফিস...এখন শান্তি। সমানে দেখছি। দেখেই চলেছি...অনেকখানি সময় নিয়ে নিজের সঙ্গে থাকছি। তখন কারও সঙ্গে কথা বলিনা। গতকাল ঝড় দেখছিলাম। ইচ্ছে হল ক্যামেরা নিতে।অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বিদ্যুতের শিখা বন্দি করলাম নিজের কাছে। আগে এমন করে চেয়ে থাকতে শিখিনি। বড্ড লোভ যে আমাদের। অনেককিছু পাওয়ার লোভ। প্রকৃতিকে নিজের কাছে সম্মান করে রাখতে শিখিনি আমরা। কালো কড়া কফি আর কলা। ব্রেকফাস্ট শেষ।গতকাল মান্নাদে-র গান শুনেছি দুপুর অবধি।উফফ! কী শিল্পী ছিলেন। পড়ছিলাম পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘আমি গান গাইতে ভালবাসি আর শ্রোতাকে যেন গান শুনিয়ে আনন্দ দিতে পারি’...সত্যিই তাই। আমার মৃত্যুর পর আমার ছবি যদি থেকে যায় একজন পরিচালক হিসেবে সেটাই আমার পাওয়া।

সকাল সাড়ে ১০টা

কলকাতা পুলিশের জন্য একটা কাজ করেছি। সেটা আর কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হবে। সেটা করতে গিয়ে এক অচেনা কলকাতাকে দেখে এলাম। পুলিশের পারমিশন নিয়ে মাস্ক পরে স্যানিটাইজ করা গাড়িতে আমরা বেরিয়েছিলাম।থমথমে চারিদিক। গা ছমছম করে। দুপুরের খাঁ খাঁ কলেজস্ট্রিট। বইপাড়ার ঝাঁপ বন্ধ! হঠাৎ দূর থেকে দেখি এক দল মানুষ ছুটে আসছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ লাগলে মানুষ যেমন শত্রুর দিকে তেড়ে আসে।সেরকম। পরে দেখলাম, কোনও এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খাবার নিয়ে এসেছে। সেই খাবারের জন্য বইপাড়ায় মানুষ ছুটছে...

রাতের আকাশ ছিন্নভিন্ন করা বিদ্যুৎশিখা বন্দি অরিন্দমের ক্যামেরায়।

আরও পড়ুন: ‘বাজিগর’-এ আনকোরা শাহরুখের সঙ্গে কাজই করতে চাননি শ্রীদেবী!​

এর পরে খাওয়া নিয়ে বড়াই করি আমরা? রোজ বাজার যেতে হবে টাটকা মাছের জন্য? এই কুৎসিত কলকাতাকে আর নিতে পারছি না।নিতে পারছি না বাসন মাজার ছবি। আমার বাড়িতে বাইরের গৃহপরিচারিকা আসছে না। বাড়িতে একজন আছেন যিনি সাহায্য করেন। আমি আমার যা কাজ করার কথা করছি। না, আলাদা করে লিখতে পারব না। বাইরে তাকিয়েই থাকি। এই নির্মলতা আমাকে শীতল করে দিচ্ছে। রাগ, ক্ষোভ, হিংসা থেকে দূরে আছি আমি। এরকম খবর এলেও দূরে সরিয়ে রাখছি। কলকাতা এত পরিষ্কার দেখে মনে হচ্ছে আমি কলকাতায় নেই। আমরা এত নিজেদের কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছি যে মনে হচ্ছে, সব স্বাভাবিক হলে আবার বোধহয় ওই পুরনো ছোটাছুটিতে ফিরে যাব। এ বার যাই, জুমে কাজ শুরু হবে।

সকাল সাড়ে ১১টা

নতুন হিন্দি ছবির কাজ শুরু হয়েছে। দেখা যাক। মুম্বইতে প্রযোজকের সঙ্গে কথা চলছে। আপডেট করছি। নীলরতন দত্তও ফোন করলেন। ক্যামেলিয়া প্রোডাকশনের বেশ কয়েকটা ছবি আটকে আছে। কখন কী হবে? সবাই চিন্তা করছে। আমি তো কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’-এর সঙ্গে যুক্ত। এখন একটু ভাল করে সময় দিতে পারছি।বিদেশ থেকে টুইট আসছে প্রায়। আজ একজন লিখেছেন শিলিগুড়িতে তাঁর বৃদ্ধ বাবা থাকেন। কলকাতা পুলিশ সরাসরি যুক্ত না হলেও লকডাউনের সময় শিলিগুড়ি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই বৃদ্ধর বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দিল। কলকাতা পুলিশ সত্যি যে ভাবে করছে, বিস্মিত হচ্ছি বার বার। ফাঁকা রাস্তায় মাস্ক পরে ডবল শিফ্টে ডিউটি করছে পুলিশ।শুক্লা খাওয়ার জন্য ডাকছে।

দুপুর ২টো

বাড়িতে একটানা এতদিন থাকা হচ্ছে।তবে একটাই পদ রান্না হচ্ছে বাড়িতে। ব্যস! খুব মাছ খেতে ভালবাসি আমি। একমাস হয়ে গেল ওই বাজার যাওয়া, মাছ কেনা, সব বন্ধ। কোনও ক্ষতিও হয়নি এতে! তবে আমাদের টাওয়ারের নীচে ফল, ব্রেড, সব্জি, চাল আসছে। আমরা তুলে আনছি। টাকাও হাতে হাতে দেওয়া হচ্ছে না। টেবিলে রাখা হচ্ছে। যতটা সম্ভব সংযোগ ছিন্ন করে বাঁচছি। ঘুরে ফিরে প্রকৃতি বলে যাচ্ছে,‘দেখ কেমন লাগে’। বেশি খাওয়া, ব্র্যান্ডেড জিনিস কেনা, কথায় কথায় জামাকাপড় কেনা, এ সব কোথায় গেল? এ সব ছাড়াই আমরা চলেছি। ওগুলো যে নিষ্প্রয়োজন, প্রকৃতি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ঘাড় ধরে শেখাচ্ছে সিম্পল লিভিং।

দুপুর ৩টে

সন্দীপ ভুতোরিয়া ফোন করেছিল। ওর ‘দ্য বেঙ্গল’পেজ থেকে ও কিছু করতে চায়। যেমন বলা তেমনই কাজ। ‘লকডাউন লাইভ’বলে ২৪এপ্রিল সন্ধে ৭টায় একটা শো করা হবে। যে সমস্ত শিল্পীর আর্থিক অবস্থা ভাল নয় তাঁরা এখানে পারফর্ম করবেন এবং তাঁদের সাম্মানিক দেওয়া হবে। বাংলায় কত শিল্পীর ঘরে তো আজ চাল অবধি নেই। বিকেল নামবে বড় হয়ে।

বিকেল সাড়ে ৪টে

বৈশাখের আকাশকে দেখি। এই গোধূলিবেলা আমার নিজস্ব।মনের ভেতরকার হিসেবনিকেশের খাতাকে ঝালাই করেনি। মানুষের তৈরি মারণরোগে মানুষ বিপর্যস্ত! সংযোগ ছিন্ন করে যদি হৃদয়ের সংযোগ বাড়ানো যায়?

আরও পড়ুন: করোনা-যুদ্ধে প্রান্তিক মানুষ কী ভাবে বেঁচে থাকবে? প্রশ্ন তরুণ মজুমদারের

বিকেল ৫টা

লকডাউনের মহানগরী।

সেই আগেকার মতো এক কাপ চা আর বিস্কুট ফিরেছে জীবনে।এরপর হাঁটার সময়। প্রায় তিন-চার কেজি ওয়েট কমেছে। হাঁটার জন্য মুখিয়ে থাকি।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা

আমি আর শুক্লা হাঁটতে বেরোই। ওই সময়ে পায়েল নামে। রাজ-শুভশ্রী নামে। তবে সকলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটা হয়। রাজের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। এক ঘণ্টা আমাদের কমপ্লেক্সের নীচে হাঁটি।

রাত ৯টা

খুব হাল্কা খাই। দই আর ফল।সিরিজ দেখব তারপর। মধ্য রাত অবধি।

ছবি: অরিন্দম শীল।

( অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)​

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement