বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
আমি বাঙালি। তাই প্রত্যেক বছর পুজো এলেই তার সঙ্গে মনের মধ্যে ভিড় করে একগুচ্ছ স্মৃতি। সেই সঙ্গে পুজো যত এগিয়ে আসে, ততই আমার ব্যস্ততা বাড়ে। এই বছর আমাদের জুহুর দুর্গাপুজোর ২১ বছর। পুজোর আর মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে। তাই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে।
২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি খুব বড় করেই পুজোর আয়োজন করেছি। পরবর্তী দু’বছর অতিমারির জন্য ছোট পরিসরে পুজো করেছি, কিন্তু মায়ের পুজো বন্ধ করিনি। গত বছর থেকে কুপার হাসপাতালের বিপরীতে জুহু ক্লাব মিলেনিয়ামে আমাদের পুজোর আয়োজন শুরু করেছি। এ বারেও কলকাতা থেকে আমার টিম চলে এসেছে। কলকাতা থেকে মাটি এনে অমিত পাল মায়ের মূর্তি তৈরি করছেন। পাশাপাশি, ঢাকি, ঠাকুরমশাই— সবাই ধীরে ধীরে চলে আসবেন।
পুজোর দিনগুলো আমার মূলত মণ্ডপেই কেটে যায়। গত ২০ বছর আমরা ডাকের সাজের প্রতিমা পুজো করেছি। তবে এই বছর আমরা আর একচালার প্রতিমা করছি না। প্রতি বছরই সন্ধ্যায় বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠান থাকে। এই বছর থাকছে ‘দুর্গানৃত্য’। আরও একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এই বছর মহম্মদ রফির জন্মশতবর্ষ। ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সপ্তমীর দিন বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। ওঁর পরিবারের সদস্যেরাও উপস্থিত থাকবেন। তাঁদেরও সম্মান জানানো হবে।
মুম্বইয়ে পুজো শুরু করার আগে পরিবারের সঙ্গে আমিও ঠাকুর দেখতে যেতাম। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতাম। কিন্তু তার পর আমাদের পুজো শুরু হওয়ার পর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে আপনাদের একটা বিষয় না জানালেই নয়। আমার পুজো কিন্তু আমার স্ত্রী ইরা শুরু করে। তার নেপথ্যেও অন্য কারণ রয়েছে। আমার মেয়ে একবার খুব অসুস্থ হয়। মেয়ের সুস্থতার জন্য আমার স্ত্রী মায়ের কাছে মানসিক করেন। মেয়ে সুস্থ হওয়ার পর ২০০৪ সাল থেকে ও পুজোটা শুরু করে।
বিশ্বজিতের দুর্গাপুজোয় রোশন পরিবারের সদস্যেরা। — ফাইল চিত্র।
আমাদের পুজোয় নিয়ম করে কোনও তারকা আসেন না। যখন যিনি সময় পান, তিনি চলে আসেন। তবে নিয়ম করে একটি পরিবারই আমার পুজোয় আসে, সেটা হল বলিউডের রোশন পরিবার। হৃতিক রোশন, রাকেশ রোশন, রাজেশ রোশন— তাঁরা প্রতি বছর আমার পুজোয় আসেন। এটা শুরু হয়েছিল রাকেশ রোশনের মা ইরা রোশনের হাত ধরে। তিনি এই পুজোয় সঙ্গে খুবই জড়িয়ে ছিলেন। কারণ ইরা ছিলেন বাঙালি। আমাকে তিনি ‘বড় ছেলে’ বলে ডাকতেন। মনে আছে, রাকেশ আমাদের পুজোয় প্রথম বছর সংকল্প করার পর সোজা ‘কহো না প্যার হ্যায়’ ছবির গান রেকর্ড করতে গেল। তার পর থেকে তো ওদের পর পর সাফল্য। তাই আমার পুজোয় ওরা নিয়মিত আসে। তবে ‘কাইটস’ ছবিটার শুটিংয়ের জন্য এক বার ওরা কেউই এই পুজোয় উপস্থিত থাকতে পারেনি। শুটিং চলছিল মেক্সিকোয়। সেখান থেকে রাকেশ রোশন আমাকে নিজে ফোন করে বিষয়টা জানিয়েছিল। তবে এই বছরেও ওরা আসতে পারবে না। কারণ, পুরো রোশন পরিবার এ বার ইউরোপ ঘুরতে যাচ্ছে। কিন্তু তা বলে দায়িত্ব থেকে সরে যায়নি। পুজোর সামগ্রী, মায়ের শাড়ি— সব কিছু আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।
পুজোর সময়ে মুম্বইয়ে থাকলে বুম্বা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) আমার পুজোয় আসে। পুজোর সময়ে বুম্বার প্রায় প্রত্যেক বছর একটা না একটা বাংলা ছবি মুক্তি পায়। তাই সময় করতে পারে না। আমিও খুব একটা জোর করি না। এ বছরেও শুনেছি, ও পুজোর মধ্যে একটা হিন্দি প্রজেক্টের শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকবে। অর্পিতাও (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়) প্রায়ই আমার পুজোয় আসে। ভোগ বিতরণ করা থেকে শুরু করে গান গাওয়া— পুজোয় খুব সুন্দর ভাবে অংশ নেয়। তা ছাড়া, মিশুকও (প্রসেনজিৎ অর্পিতার ছেলে তৃষাণজিতের ডাক নাম) এখন বড় হচ্ছে। অনুপম খেরের অভিনয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়াশোনা করছে। ছেলেকে নিয়ে ওরা দু’জনেই ব্যস্ত। আমি ১৫-১৬ বছর আগে বুম্বাকে মুম্বইয়ে কাজ করতে বলি। তখন ও রাজি হয়নি। কিন্তু এখন ও এখানে কাজ করছে দেখে আমি খুবই খুশি। সোমবার বুম্বার জন্মদিন ছিল। একটা মজার বিষয় বলি। আমার বাবা এবং বুম্বার জন্মদিন একই দিনে। ১ অক্টোবর আবার অর্পিতার জন্মদিন। এই দিনগুলো আমার খুব মনে থাকে।
মুম্বইয়ের পুজো নিয়ে তো অনেক কথা হল। একটু কলকাতার কথাও না লিখলে নয়। এই বছর আরজি কর-কাণ্ডের জন্য কলকাতায় অন্য রকমের পরিবেশ। জানি না, বাংলায় অন্যান্য বছরের মতো পুজো হবে কি না। প্রতিবাদের পাশাপাশি মানুষ পুজোয় অংশ নেবেন কি না, সেটাও জানি না। এখনও তো মুম্বইয়ের পুজোয় ব্যস্ত থাকি। কিন্তু টিভির পর্দায় বাংলার পুজোর খবর দেখি। তবে কলকাতার পুজোর সঙ্গেও আমার অনেক স্মৃতি।
ষাটের দশকে কলকাতা থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিটা করতে মুম্বই চলে আসি। সেই সময় আমি সব প্রযোজককে বলতাম, সারা বছর কাজ করব। কিন্তু পুজোর সময়ে আমাকে পাঁচ দিনের ছুটি দিতেই হবে। আমি কলকাতায় চলে যাব। আর সত্যিই কলকাতায় চলেও যেতাম। সকলের সঙ্গে আনন্দ করতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে ঠাকুর দেখতে যেতাম। কারণ, মুম্বইয়ে আমি তখন সুপারস্টার। একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। সে বার আউট্রাম ঘাটে বিসর্জন দেখতে গিয়েছি। আমাকে ঘিরে মানুষের ভিড়! আমার গাড়ির চারপাশে শুধু কালো মাথা। গাড়ির উপরে পর্যন্ত মানুষ উঠে পড়েছিলেন! সে যাত্রায় কলকাতা পুলিশ আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেছিল। পুজো নিয়ে আমার প্রচুর স্মৃতি। তাই লিখতে গেলে হয়তো লিখতেই থাকব।আনন্দবাজার অনলাইনের পাঠকদের আমার তরফে শারদীয়ার শুভেচ্ছা।