যখন আমরা কৈশোর পার হয়ে প্রথম-তারুণ্যে পা রেখেছি, আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে, যখন আমাদের প্রেম-চেতনা জাগ্রত হচ্ছে কিন্তু সামনে কোনও নির্দিষ্ট প্রেমিকা নেই— সেই সময়টায় ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ শব্দটির কোনও অস্তিত্বই ছিল না আমাদের জীবনে। ওই শব্দটি সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে শুনতে পাচ্ছি আর দেখতেও পাচ্ছি এই বিশেষ দিনটির নানা ধরনের উদযাপন। সদ্য তারুণ্যে পৌঁছনো ছেলেমেয়েদের জোড়ায় জোড়ায় হাতে হাত ধরে রাস্তা হাঁটতে দেখি। এফএম রেডিয়োতে এই দিনটি উপলক্ষ করে লাগাতার অনুষ্ঠান হয়। প্রণয়দিনের উপযোগী গান বাজতে থাকে। কিন্তু কাকে বলে প্রেমের দিন সে কথা এখনও বুঝি?
আমাদের সময়ে সরস্বতী পুজোর দিনটির মধ্যে অলিখিত একটি প্রেমদিবস লুকনো থাকত। বালিকা বিদ্যালয়ের কিশোরীরা সে দিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের, অর্থাৎ ছেলেদের স্কুলে প্রতিমা দর্শনে আসত। উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে যারা একটু বলিয়ে-কইয়ে ছিল, যাকে বলে স্মার্টনেস ছিল যাদের, তারা ঠাকুর দেখতে আসা মেয়েদের সঙ্গে কথা বিনিময় করার সাহস দেখাত। মেয়েদের মধ্যেও স্মার্ট মেয়ের অভাব যে ছিল সে কথা বলা যাবে না। তারাও খুব স্বচ্ছন্দে কথা চালিয়ে নিতে পারত।তবে কেউ কাউকে ‘তুই’ সম্বোধন করত না। অচেনা, সদ্যচেনা মেয়েদের একলাফে ‘তুই’ বলার রেওয়াজ চালু হয়নি তখনও।
ওই সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় আলাপ হওয়া কোনও কোনও ছেলেমেয়ে সেই আলাপকে দীর্ঘায়িত করে তুলতে সক্ষম হত ছেলেটির ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে। এ-বিষয়ে ছেলেদের আগ্রহই বেশি পরিমাণে দেখা যেত, মেয়েটির দিক থেকে রাস্তায় আসা যাওয়ার পথে অল্প একটু সাড়া পাওয়াকেই যথেষ্ট পরিমাণে সাফল্য বলে ধরে নেওয়া হত। তবে এই ধরনের কৌশোরকালীন প্রেম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল অত্যন্ত স্বল্পস্থায়ী। মেয়েটির দিক থেকে সরে যাওয়াটা ঘটত প্রায় সব সময়েই। রাস্তায় দু’-চার কদম একসঙ্গে হাঁটলেও মেয়েটির ‘বাড়ির লোক’ দেখে ফেলবে, এই অত্যন্ত সঙ্গত কারণ উপস্থিত করে অপসৃত হত।পরেও যোগাযোগ করা যেত না মেয়েটির সঙ্গে। তবে অতি অল্প হলেও এমন ঘটনাও ঘটেছে যে সরস্বতী পুজোর দিন আলাপ হওয়া কিশোরপ্রেম অন্তত এক বার-দু’বার বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু সে সব হল মস্ত ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। মাত্র দু’টির বেশি এমন ঘটনা আমি মনে করতে পারছি না।
এই যে এখন সরস্বতী পুজো আসে, আমার মনে কি কোনও প্রেমানুভূতির আবেশ জন্ম নিতে পারে? মোটেই না। ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ তো আমার কাছে কোনও বিশেষ অর্থই বহন করে না। তবে এ যুগের কাছে করে। যে যুগের যা স্বভাব। ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক গানের ব্যান্ড ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’উপলক্ষে এক বার একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল রবীন্দ্রসদনে। আমার মেয়ের তাগাদায় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম আমিও।আমার মেয়ে তখন কিশোরী। দেখলাম, চন্দ্রবিন্দু-র একের পর এক গান অনুরোধ করছে সদ্য তারুণ্যপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েরা। একসময় সেই শ্রোতারা সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে মঞ্চের সামনের জায়গাটুকুতে দলবেঁধে নাচতে লাগল গানের তালে তালে। ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র এমন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দময় উদযাপন দেখতে দেখতে আমারও মন খুশি হয়ে উঠল।
‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নিয়ে কিছু লেখা আমার অধিকারের আওতার মধ্যেই পড়ে না। এই বিশেষ দিনটিকে আলাদা ভাবে অনুভব করার বয়স আমি কবেই পিছনে ফেলে এসেছি।স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর মতো লেখক, শ্রীজাত-র মতো কবি এই দিনটির বিষয়ে লিখলে উপলক্ষটির প্রতি সুবিচার করা হয়। কেবল এরা বয়সে তরুণ বলে নয়, এদের লেখা তরুণ-তরুণীরা বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পড়ে। এ বারও বইমেলায় স্মরণজিৎকে ঘিরে একঝাঁক তারুণ্যকে দেখলাম আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলের বাইরে। স্মরণজিৎ সই দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমারসিগনেট স্টলে বসা শ্রীজাত বিষয়েও।
তবে বইমেলার একেবারে শেষ দু’-তিনটি দিনে দুপুর-বিকেলে মেলার মাঠে, বিশেষ রকমের এক রোদ্দুর দেখা যায়। বিশেষ রকমের একটা হাওয়া ওঠে থেকে থেকে। কোথা থেকে আসে ওই হাওয়া? সেই রোদ্দুর, সেই হাওয়া কি‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র পূর্বাভাস দেয়? আবার ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র দিন যে-বাতাস বয়, যে-বিশেষ রোদ্দুর ওঠে, সেই হাওয়া আর রোদমনে করিয়ে দেয় দোল তো এসে পড়ল প্রায়! দোল মানে বসন্ত উৎসব। দোল মানে আবির। সরস্বতী পুজোর দিন থেকে আরম্ভ হয়ে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-কে স্পর্শ করে আবিরমাখা বসন্ত উৎসবের দিকে যাত্রা করে প্রেম। আমরা কেউ তাতে অংশ নিই, আর আমার মতো কেউ শুধু দর্শক হয়ে থেকে যাই।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস