নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মায়ানগরীতে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে একসঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ কেরিয়ারে ১৫০-এর বেশি ছবিতে অভিনয় করে ফেললেও, নায়ক হওয়ার আর হয়ে ওঠেনি। বরং আজীবন নেগেটিভ চরিত্রেই সিলভারস্ক্রিনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন গোগা কপূর।
সত্তর ও আশির দশকের নামজাদা ভিলেনদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলেন গোগা। অমরীশ পুরীর মতো অভিনেতাও তাঁকে অনুকরণ করতেন বলে শোনা যায়। পর্দার ভিলেন গোগা কপূরের বাস্তব জীবন নিয়েই দিব্যি ছবি তৈরি করে ফেলা যায়।
১৯৪০ সালের ১৫ ডিসেম্বর গুজরানওয়ালায় একটি ধনী পরিবারে জন্ম রবীন্দ্র কপূর ওরফে গোগার। দেশভাগের পর গুজরানওয়ালা পাকিস্তানের দখলে চলে যায়। তল্পিতল্পা গুটিয়ে সেখান থেকে ভারতে চলে আসে তাঁর গোটা পরিবার।
পাকিস্তানে তাঁদের প্রচুর সম্পত্তি থাকলেও, সে সব ছেড়েই এ দেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয় গোগা কপূরের পরিবার। ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার সেই যন্ত্রণার মধ্যেই তাঁদের সঙ্গে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়।
হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে গোগা কপূরের বাবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। সাধ্য মতো সব চেষ্টা করেও তাঁর হদিশ পাননি পরিবারের লোকজন। অতএব অভিভাবকহীন ভাবেই নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে হয় তাঁদের।
কিন্তু স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলনের আশা ছাড়েননি গোগা কপূরের মা। একা হাতে ছেলেমেয়েদের বড় করলেও, স্বামীর দেখা এক দিন পাবেনই, এই বিশ্বাস ছিল তাঁর। এ ভাবে বেশ কয়েক বছর কাটার পর একটি কফিশপে ফের স্বামীর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর।
ছোট্ট বয়সে দেশভাগের যন্ত্রণার সাক্ষী হয়েছিলেন গোগা কপূর। সারা জীবন তার ক্ষত বুকে বয়ে বেরিয়েছেন তিনি। অল্প বয়স থেকেই বিভিন্ন নাটক ও থিয়েটার দলের সংস্পর্শে আসেন তিনি। কলেজে পড়ার সময় ইংরেজি থিয়েটারেও অভিনয় করেন। সেখান থেকেই অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা জন্মায় তাঁর।
সেই মতো মায়ানগরীতে পা রাখেন গোগা কপূর। সেই সময় বলিউডে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে এসেছিলেন অমিতাভ বচ্চনও। দু’জনের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তবে পরবর্তী কালে অমিতাভ যেখানে শতাব্দির সেরা সুপারস্টারে পরিণত হন, গোগা কপূর সেখানে খলনায়ক এবং চরিত্রাভিনেতার ভূমিকাতেই আটকে পড়েন। এমনকি অমিতাভ অভিনীত ছবিতেও ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে।
‘জ্বালা’ ছবিতে সুনীল দত্ত এবং মধুবালার মতো শিল্পীদের সঙ্গে প্রথম কাজের সুযোগ পান গোগা। মধুবালার মৃত্যুর পর ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিতে ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে। তার সুবাদে একাধিক আঞ্চলিক ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান গোগা।
কিন্তু বছর দু’য়েক আঞ্চলিক ছবিতে চুটিয়ে অভিনয় করার পর ফের মূলধারার হিন্দি ছবিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ মেহরার ‘এক কুঁয়ারি এক কুঁয়ারা’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে কামব্যাক করেন গোগা কপূর। আর সেই বছরই অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ‘জঞ্জির’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান।
এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি গোগা কপূরকে। ‘ইয়াদোঁ কি বারাত’, ‘হিমালয় সে উঁচা’, ‘হেরাফেরি’, ‘মুকদ্দর কা সিকন্দর’, ‘মিস্টার নটবরলাল’, ‘দোস্তানা’, ‘শান’, ‘ইয়ারানা’, ‘সত্তে পে সত্তা’, ‘কুলি’, ‘বেতাব’, ‘মর্দ’, ‘তুফান’-এর মতো একাধিক সুপারহিট ছবিতে দেখা যায় তাঁকে।
এরই মধ্যে টুকটাক টেলিভিশনেও কাজ করতে শুরু করেন গোগা কপূর। তবে ১৯৮৮ সালে বি আর চোপড়ার হাত ধরেই কেরিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজটি হাতে পান তিনি। ‘মহাভারত’ সিরিয়ালে তাঁকে রাজা কংসের চরিত্রটি দেন বি আর চোপড়া। তাতেই রাতারাতি ঘরে ঘরে পরিচিতি তৈরি হয়ে যায় গোগা কপূরের।
এর পরে ‘শিব মহাপুরাণ’ সিরিয়ালে রাবণ এবং ‘জয় গণেশ’ সিরিয়ালে তারকাসুরের ভূমিকাতেও দেখা যায় তাঁকে। ‘শক্তিমান’ সিরিয়ালে বিলাস রাওয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। একই সঙ্গে বড়পর্দাতেও চুটিয়ে কাজ করেন গোগা কপূর। ১৯৮৮ সালে নবাগত আমির খানের সঙ্গে ‘ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তক’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। সলমন খানের সঙ্গে ‘পাত্থর কে ফুল’, শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘কভি হাঁ কভি না’ ছবিতেও কাজ করেন গোগা কপূর।
২০০০ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ‘রিফিউজি’, ‘রাজা কো রানি সে প্যায়ার হো গয়া’, ‘রান’, ‘ডি’-র মতো একাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। একই সঙ্গে মালয়ালম ছবিতেও নিয়মিত দেখা যায় তাঁকে। ২০০৬ সালের ‘দরওয়াজা বন্ধ রাখো’-ই গোগা কপূরে অভিনীত শেষ হিন্দি ছবি।
এর পর বার্ধক্যজনিত কারণে অভিনয় থেকে সরে আসেন গোগা কপূর। ২০১১-র ৩ মার্চ বার্ধক্যজনিত কারণে ৭০ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর কন্যা পায়েল কপূরও অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।