মনে হয়েছিল, কণ্ঠস্বর ভারী। তাই একসঙ্গে গান করতে রাজি হননি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সহমর্মিতার স্পর্শেই পাল্টে গেল গায়িকার জীবন। ঘর বাঁধলেন দু’জনে। শ্রোতার কাছে গজলকে পেশ করলেন নতুন আঙ্গিকে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে বারবার শোকে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন জগজিৎ-চিত্রা।
১৯৬৭ সালে তখনও পায়ের তলায় শক্ত জমি পেতে লড়াই করছেন পঁচিশ বছর বয়সি যুবক, জগজিৎ। আকাশবাণীর জালন্ধর স্টেশনে ধ্রুপদী সঙ্গীত গাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। সেই অভিজ্ঞতা সম্বল করেই ১৯৬৫ সালে বাড়ির লোককে অন্ধকারে রেখে চলে আসেন বম্বে, আজকের মুম্বই।
বলিউডে এসে প্রথমে বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল গাইতেন জগজিৎ। প্লেব্যাকের সুযোগ সবে আসতে শুরু করেছে। কেরিয়ারের একেবারে শুরুতে, এমন একটা কঠিন সময়ে জগজিতের সঙ্গে আলাপ চিত্রা দত্তর সঙ্গে।
নামী বিজ্ঞাপন সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মীর ঘরনি চিত্রাও তখন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বামীর সঙ্গে প্রবল অশান্তি। ব্যক্তিগত জীবনের ঝড় আড়াল করেই স্টুডিয়োতে যেতেন গান রেকর্ড করতে।
স্টুডিয়োতেই চিত্রার আলাপ জগজিতের সঙ্গে। প্রথমে জগজিতের কণ্ঠস্বরকে ভারী বলে মনে হয়েছিল চিত্রার। তিনি একসঙ্গে রেকর্ড করতে রাজিও হননি। পরে জগজিতের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যান চিত্রা।
স্বামীর সঙ্গে কী কারণে চিত্রার সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল, তা জানা যায় না। তবে ব্যক্তিগত জীবনে টানাপড়েনের সময় জগজিতের সহমর্মিতা তাঁর ভাল লেগেছিল।
১৯৬৮ সালে স্বামীকে ছেড়ে মেয়ে মনিকাকে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন চিত্রা। কিন্তু তখনও তিনি জগজিতের বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দেননি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেষে জগজিৎ দেখা করেন চিত্রার স্বামীর সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে অনুমতি চান চিত্রাকে বিয়ে করার!
১৯৬৯ সালে মেয়ে মনিকার কাস্টডি নিশ্চিত করে স্বামীকে ডিভোর্স করেন চিত্রা। সে বছরই তিনি বিয়ে করেন জগজিৎ সিংহকে।
বিয়ের পরে নিজেদের আরও বেশি করে সঙ্গীতসাধনায় ডুবিয়ে দিলেন জগজিৎ-চিত্রা। অনুষ্ঠান, ব্যক্তিগত রেকর্ড, প্লেব্যাক, সবদিকেই শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে গেলেন দু’জনে। কখনও একসঙ্গে, কখনও একা, জগজিৎ-চিত্রার গানে বুঁদ সাধারণ মানুষ থেকে সমঝদার শ্রোতা।
চেনা গণ্ডির সমঝদার শ্রোতার বাইরে সাধারণ মানুষের কাছেও গজলকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন জগজিৎ-চিত্রা। তাঁদের যুগলবন্দিতে ‘দুনিয়া জিসে কেহতে হ্যায়’, ‘তুম কো দেখা তো ইয়ে খয়াল আয়া’, ‘বাবুল মোরা নাইহার’, ‘কোই সমঝেগা ক্যায়া রাজ’, ‘উস মোর সে শুরু করেঁ ফির ইয়ে জিন্দগি’, ‘দিল এ নাদান তুঝে হুয়া’, ‘বহোত পেহলে সে উন কদম’... তাঁদের সেরা সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম।
এর মধ্যেই শিল্পী দম্পতির জীবনে আচমকাই সুর কেটে গেল। ১৯৯০ সালের ৮ জুলাই মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান জগজিৎ-চিত্রার একমাত্র ছেলে, বিবেক। আঠেরো বছর বয়সি বিবেক ছিলেন প্রতিশ্রুতিমান ক্রিকেটার।
দুই বন্ধু রাহুল মুজুমদার এবং সাইরাজ বাহুতুলেকে নিয়ে গাড়িতে ছিলেন বিবেক। গাড়ি চালাচ্ছিলেনও তিনি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁদের মারুতি জিপসি একটি ভ্যানকে ধাক্কা মারলে ঘটে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারান বিবেক। মারাত্মক আহত হন রাহুল ও সাইরাজ। পরে অবশ্য তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। বাহুতুলে জাতীয় দলে খেলেওছিলেন।
ছেলের মৃত্যুশোকে মর্মাহত চিত্রা গান গাওয়াই ছেড়ে দেন। বিবেকের মৃত্যুর পরে স্বামীর সঙ্গে একটিমাত্র দ্বৈত অ্যালবাম প্রকাশ করেন চিত্রা। এরপর তিনি আর প্রকাশ্যে গান করেননি। রেকর্ডিং বা প্লেব্যাক বা সঙ্গীতানুষ্ঠান, কোথাও ফিরিয়ে আনা যায়নি চিত্রাকে। জগজিৎ অবশ্য গানের জগতে ফিরেছিলেন। পুত্রশোকে বাবার রক্তাক্ত হৃদয় যেন ধরা দিত তাঁর গানে।
এখানেই শেষ নয়। দুই সুরসাধকের জীবনের বাঁকে আরও শোক বাকি রয়ে গিয়েছিল। ২০০৯ সালে পঞ্চাশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন চিত্রার প্রথম পক্ষের মেয়ে, মনিকা।
মনিকার প্রথম বিয়ে ১৯৮৮ সালে সিনেম্যাটোগ্রাফার জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে। তাঁদের দুই ছেলে আরমান এবং উমের। জাহাঙ্গীর-মনিকার বিবাহবিচ্ছেদ ২০০৫ সালে। এরপর মনিকা বিয়ে করেন ব্রিটিশ নাগরিক মার্ক হিউটন রজার অ্যাটকিন্সকে। কিন্তু সে বিয়েও সুখের হয়নি। অ্যাটকিন্সের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ আনেন মনিকা। জামিনঅযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান অভিযুক্ত অ্যাটকিন্স। দু’টি ব্যর্থ বিয়ের বোঝা সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হন মনিকা।
এর দু’বছর পরে প্রয়াত হন জগজিৎ সিংহ। ইংল্যান্ড সফরের পরে গুলাম আলির সঙ্গে জগজিতের অনুষ্ঠান করার কথা ছিল মুম্বইয়ে। তার আগেই তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দু’সপ্তাহ কোমায় থাকার পরে সত্তর বছর বয়সি জগজিৎ প্রয়াত হন ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর।
সত্তরোর্ধ্ব চিত্রা এখন একা। তাঁর নিঃসঙ্গতার সঙ্গী জগজিতের গান আর দুই নাতি, আরমান-উমের। এ সবের মাঝেই আবর্তিত হয় চিত্রার একাকিত্ব।