bollywood

নাচে বিতৃষ্ণা বলে প্রত্যাখ্যান নায়কের ভূমিকা, ‘খলনায়ক’ প্রাণের অভিনয় শুরু রামলীলায় সীতা সেজে

ক্রমে তিনি নিজেকে সরিয়ে আনেন শুধুমাত্র নেগেটিভ চরিত্রেই। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, নায়িকার সঙ্গে নাচগান করা তাঁর সঙ্গে মানানসই হচ্ছে না। বিশেষ করে ছবিতে নায়কের নাচের দৃশ্যে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। ফলে বেছে নেন নেগেটিভ চরিত্রই। দ

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:৩৬
Share:
০১ ২০

সুপুরুষ এবং অভিনয়ে সাবলীল। নায়ক হওয়ার সবরকম বৈশিষ্ট্য ছিল পূর্ণ মাত্রায়। কিন্তু তিনি পর্দায় খলনায়ক হয়েই থাকলেন। কখনও কখনও চিত্রনাট্যে তাঁর গুরুত্ব টক্কর দিত নায়কের সঙ্গে। তাঁর কথা ভেবে আলাদা করে সংলাপ লেখা হত। শুধু নামে নয়, অভিনয়েও তিনি ছিলেন যে কোনও ছবির সাফল্য ও বৈচিত্রের ‘প্রাণ’।

০২ ২০

এক সম্পন্ন পরিবারে প্রাণের জন্ম ১৯২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। অবিভক্ত ভারতের লাহৌরের লক্ষ্মী চকে। তাঁর বাবা কেবলকৃষণ সিকন্দ ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কাজ করতেন সরকারি সিভিল কন্ট্রাক্টর হিসেবে। কেবল কৃষণ এবং তাঁর স্ত্রী রামেশ্বরীর মোট সাতজন সন্তান। চার ছেলে এবং তিন মেয়ে।

Advertisement
০৩ ২০

তাঁর বাবার মতো প্রাণও মেধাবী ছিলেন। গণিত ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন শহরে কেটেছে প্রাণের শৈশব ও কৈশোর। দেহরাদূন, কপূরথালা, মেরঠ, উন্নাও-সহ দেশের বিভিন্ন শহরের স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। উত্তরপ্রদেশের রামপুরে হামিদ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন।

০৪ ২০

পড়াশোনার পাশাপাশি শখ ছিল অভিনয় আর ছবি তোলার। দ্বিতীয় শখকেই জীবনের প্রথম পেশা করেছিলেন। শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ফোটোগ্রাফি সংস্থা, দিল্লির এ দাস অ্যান্ড কোং-এ। বজায় ছিল অভিনয়ের নেশাও। রামলীলা-য় সীতার ভূমিকায় অভিনয় করবেন বলে শিমলায় গিয়েছিলেন। তাঁর বিপরীতে রামের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হিন্দি ছবির আর এক অভিনেতা ও অমরীশ পুরীর ভাই মদন পুরী। প্রকাশ্য মঞ্চে এটাই ছিল প্রাণের প্রথম অভিনয়।

০৫ ২০

হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ এসেছিল আচমকাই। লাহৌরের বাজারে আলাপ হয়েছিল লেখক ওয়ালি মহম্মদ ওয়ালির সঙ্গে। সেই আলাপের সূত্রেই প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পঞ্জাবি ছবি ‘ইয়ামলা জত’-এ। ১৯৪০ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন নুরজাহান এবং দুর্গা খোটে।

০৬ ২০

১৯৪২ সালে মুক্তি পায় প্রাণের প্রথম হিন্দি ছবি ‘খানদান’। এই ছবিতে তিনি পুরোদস্তুর রোমান্টিক নায়ক। তাঁর নায়িকা নুরজাহানের তখন বয়স মাত্র ১৫। লম্বায় অনেকটাই খাটো। ফলে ক্লোজ আপ শটে নায়ক-নায়িকার উচ্চতার বৈষম্য বিসদৃশ লাগল। সমস্যা দূর করতে প্রাণের পাশে নুরজাহানের পাশে দাঁড়াতে হত ইটের পাঁজার উপর। যাতে ক্যামেরায় সামঞ্জস্যপূর্ণ লাগে।

০৭ ২০

স্বাধীনতার আগে ১৯৪২-৪৬ অবধি প্রাণ মোট ২২ টি ছবিতে অভিনয় করেন। তার মধ্যে বেশির ভাগ ছবি মুক্তি পেয়েছিল স্বাধীনতার আগেই। দু’টি ছবি দেশভাগের পরে মুক্তি পেয়েছিল শুধু পাকিস্তানে। দেশভাগের পরে প্রাণ চলে আসেন আজকের মুম্বই শহরে। এই পালাবদলের সময়ে তাঁর কেরিয়ার কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছিল।

০৮ ২০

মুম্বইয়ে প্রাণ কয়েকদিন চাকরি করেছিলেন মেরিন ড্রাইভের ডেলমার হোটেলে। ১৯৪৮ সালে ফের শুরু করেন অভিনয়। লেখক সাদাত হোসেন মান্টো এবং অভিনেতা শ্যামের সাহায্যে প্রাণ অভিনয়ের সুযোগ পান বম্বে টকিজের ছবি ‘জিদ্দি’-তে। এই ছবিতে নায়ক-নায়িকা ছিলেন দেব আনন্দ এবং কামিনী কৌশল। সুপারহিট এই ছবি দেব আনন্দের কেরিয়ারে বড় ব্রেক ছিল।

০৯ ২০

‘জিদ্দি’-র ফলে প্রাণও আরবসাগরের তীরে পায়ের তলায় জমি খুঁজে পান। পর পর বেশ কিছু ছবির সুযোগ আসে তাঁর কাছে। ‘গৃহস্থি’, ‘অপরাধী’, ‘পুতলি’, ‘আদালত’, ‘জশন’ ছবিতে নিজের প্রতিভার পরিচয় রাখেন প্রাণ। এ সময় তিনি নায়ক এবং খলনায়ক, দু’রকমের চরিত্রেই অভিনয় করতেন।

১০ ২০

ক্রমে তিনি নিজেকে সরিয়ে আনেন শুধুমাত্র নেগেটিভ চরিত্রেই। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, নায়িকার সঙ্গে নাচগান করা তাঁর সঙ্গে মানানসই হচ্ছে না। বিশেষ করে ছবিতে নায়কের নাচের দৃশ্যে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। ফলে বেছে নেন নেগেটিভ চরিত্রই। দিলীপকুমার, দেব আনন্দ এবং রাজ কপূরের মতো অভিনেতা প্রাণকে পছন্দ করতেন তাঁদের ছবিতে খলনায়ক হিসেবে। নানাভাই ভট্ট, বিমল রায়, আই এস জোহার, শক্তি সামন্ত, নাসির হুসেন-সহ প্রাণের সমসাময়িক বড় পরিচালকরাও ছিলেন তাঁর অভিনয়ের ভক্ত।

১১ ২০

খলনায়কের ভূমিকাকে প্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন চরিত্রাভিনেতার পর্যায়ে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮২ অবধি তিনি পার্শ্বচরিত্রাভিনেতাদের মধ্যে সবথেকে বেশি পারিশ্রমিক পেতেন। ‘বড়ি বহেন’ ছবি থেকে প্রাণ তাঁর অভিনয়ের অন্যতম অংশ করে নিয়েছিলেন মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়ার রিং ছাড়ার ম্যানারিজমকে। পরবর্তী কালে তাঁর বেশ কিছু ছবিতে ফিরে এসেছে এই ম্যানারিজম।

১২ ২০

প্রাণের ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য হল ‘উপকার’, ‘আজাদ’, ‘দেবদাস’, ‘মধুমতী’, ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’, ‘রাম অউর শ্যাম’, ‘আদমি’, ‘জিদ্দি’, ‘মুনিমজি’, ‘চোরি চোরি’, ‘জাগতে রহো’, ‘অমরদীপ’, ‘ববি’, ‘যব প্যায়ার কিসি সে হোতা হ্যায়’-এর মতো ছবি। তাঁর সমসাময়িক নায়করা সরে গিয়েছেন চরিত্রাভিনয়ে, অথচ প্রাণ দাপটের সঙ্গে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে গিয়েছেন।

১৩ ২০

তাঁর পরের প্রজন্মের নায়ক শাম্মি কপূর, জয় মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র কুমার, ধর্মেন্দ্রর সঙ্গেও প্রাণ অভিনয় করেছেন চুটিয়ে। ‘পূজা কে ফুল’, কাশ্মীর কি কলি’, ‘জনি মেরা নাম’, ‘জোশিলা’, ‘ওয়ারেন্ট’, ‘দেশ পরদেশ’-ও তাঁর কেরিয়ারের উল্লেখযোগ্য ছবি।

১৪ ২০

পরিণত সময়ে তাঁর অভিনয়ের অংশ হয়েছিল কৌতুকপ্রবণতা। কিশোর কুমার এবং মেহমুদের সঙ্গে অভিনীত প্রাণের উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে ‘সাধু অউর শয়তান’, ‘আশা’, ‘বেওকুফ’ এবং ‘হাফ টিকিট’। অশোককুমার এবং প্রাণ ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। ১৯৫১ থেকে ১৯৮৭ সাল অবধি দু’জনে কাজ করেছেন ৮৭টিরও বেশি ছবিতে।

১৫ ২০

বলিউডে নায়কের সাম্রাজ্যে পালাবদল হয়েছে। কিন্তু খলনায়কের ভূমিকায় দীর্ঘ কয়েক প্রজন্ম ধরে অভিনয় করে গিয়েছেন প্রাণ। রাজেশ খন্না-অমিতাভ বচ্চনের সময়েও প্রাণ ছিলেন বিকল্পহীন। ‘জঞ্জীর’, ‘ডন’, ‘দোস্তানা’, ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘নসিব’, ‘শরাবি’-সহ মোট ১৪ টি ছবিতে অমিতাভের বিপরীতে খলনায়ক ছিলেন প্রাণ।

১৬ ২০

১৯৯৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন প্রাণ। এরপর অভিনয় প্রায় ছেড়েই দেন তিনি। শুধু অমিতাভ বচ্চনের অনুরোধে অভিনয় করেছিলেন বচ্চনের হোম প্রোডাকশনের ছবি ‘তেরে মেরে সপনে’ এবং ‘মৃত্যুদাতা’-য়। ২০০০ সালের পরে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স ছাড়া তাঁকে কার্যত দেখাই যায়নি। একবারই মাত্র ছবি প্রযোজনা করেছিলেন প্রাণ। ১৯৯১ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর প্রযোজিত ও অভিনীত ছবি ‘লক্ষ্মণরেখা’। অভিনয় করেছেন বাংলা ছবিতেও।

১৭ ২০

দীর্ঘ ছয় দশকের কেরিয়ারে প্রাণ অভিনয় করেছেন ৩০০টিরও বেশি ছবিতে। জনজীবনে এতটাই প্রভাব ছিল তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়ের, বলা হয় দীর্ঘদিন অবধি ভারতীয় বাবা-মায়ের পুত্রসন্তানের নাম ‘প্রাণ’ রাখতে বেশ কয়েকবার ভাবতেন। যদি পরে সে নিজের জীবনে খলনায়ক হয়! ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর সম্মানিত সম্বোধন ‘প্রাণ সাহাব’। তাঁর কণ্ঠে ‘বরখুরদার’ বলিউডে আইকনিক সংলাপের মধ্যে অন্যতম।

১৮ ২০

১৯৪৫ সালে প্রাণের বিয়ে হয় পরিবারের পছন্দ করা পাত্রী শুক্লা অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে। শোনা যায়, তাঁর আগে এক অভিজাত পঞ্জাবি তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে সম্পর্ক পরিণতি পায়নি। প্রাণের দুই ছেলে অরবিন্দ এবং সুনীল এবং এক মেয়ে, পিঙ্কি। তাঁর ছোট ছেলে সুনীলও ছবি পরিচালনা করেছেন।

১৯ ২০

‘দাদাসাহেব ফালকে’, ‘পদ্মভূষণ’ এবং অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন প্রাণ। যে কোনও ছবির ক্রেডিট টাইটেলে সবার শেষে লেখা থাকত ‘…অ্যান্ড প্রাণ’। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর উপস্থিতি সবার থেকে আলাদা, ‘এবং’ দিয়ে সেই পার্থক্য গুরুত্ব পাওয়ার মতোই। পরে তিনি নিজের জীবনীর নামও দিয়েছিলেন ‘…অ্যান্ড প্রাণ’।

২০ ২০

২০১৩ সালের ১২ জুলাই ৯৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন প্রাণ। বলিউডের তথাকথিত নায়ক বা খলনায়ক, কোনও ছাঁচেই বোধহয় ফেলা যায় না তাঁকে। ছবিতে তাঁর মেক আপের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল চোখে হাল্কা কাজলের ছোঁয়া। সেই কাজলরেখার মতোই তাঁর ভূমিকা ছিল অভিজাত, অনন্য এবং উজ্জ্বল। নীরবেই চলে গেল তাঁর জন্মশতবর্ষ। (ছবি: আর্কাইভ ও ফেসবুক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement