শ্রীলেখা মিত্র।
আজ আমার আবার মাতৃদিবস। আজ আমি সমস্ত জাতি-ধর্ম-দলের উর্ধ্বে। মা-হারাদের পাশে। হয়তো অবাক হচ্ছেন, সদ্য পেরিয়ে যাওয়া মাতৃদিবসের পরেও আমি আবার কেন মা-ময়? বৃহস্পতিবার সকালে করোনার কারণে মাতৃহারা হয়েছেন বাম দলের প্রার্থী শতরূপ ঘোষ। খবরটা শুনেই আমার ফুসফুস যেন অক্সিজেনশূন্য! মারণ সংক্রমণ ছাড়াই।
মা নেই! কাউকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই একটা কথাই যথেষ্ট। তখনই মনে পড়ল, এই তো সবাই আমরা ক’দিন আগে হইহই করে মায়েদের জন্য তুলে রাখা বিশেষ দিনটিকে স্মরণ করলাম। কিন্তু যাঁদের মা নেই? তাঁরা কী করলেন? একবারও ভেবে দেখিনি কেউ!
আসলে, যাঁদের মা চলে গিয়েছেন তাঁদের কাছে ‘মা হারানো কী যন্ত্রণার সেটা শুধু তাঁরাই বোঝাতে পারেন। মায়ের মতোই ‘মা’ ডাকটাও আর ‘নেই’ তাঁদের জীবনে। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে সব দুঃখ ভোলার রাস্তাটাও বন্ধ!
মনে পড়ছিল ‘দিওয়ার’ ছবির বিখ্যাত সেই সংলাপ, ‘মেরে পাস মা হ্যায়’। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। মা আছে মানেই যেন দুনিয়া আমার বশে। আজ থেকে শতরূপও আমার মতোই মা-হারাদের দলে। শতরূপের আগে চলে গিয়েছেন পরিচালক অনিন্দ্য সরকারের স্ত্রী। কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা! রোজ কেউ না কেউ আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আজ কারওর মা। কাল কারওর স্ত্রী। পরশু কারওর সন্তান। আর কতদিন এ ভাবে মৃত্যুমিছিল চলবে? খুব ভয় করে আমার ছেলেমেয়েগুলোর জন্য। ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’দের প্রসংশায় পঞ্চমুখ সবাই। কিন্তু ছোট ছোট ছেলেপুলের দল যখন বিপদ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কেউ এতটুকু সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন না।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দলের এক ছেলের কথা। ১৪ বছরের এক কিশোরী আক্রান্ত সংক্রমণে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বর্তেছিল তার উপর। অক্সিজেন নেই। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি করছে। একটু শ্বাস নেবে বলে মেয়েটির কী ছটফটানি! দেখে আর স্থির থাকতে পারেনি দলের ছেলেটি। একাই কোলে তুলে নিয়ে ছুটেছিল হাসপাতালের দিকে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের গতির সঙ্গে কি মানুষ পারে? সদস্যের কোলের মধ্যেই ছটফট করতে করতে হঠাৎ একদম স্থির কিশোরী। ছেলেটি পরে আমার কাছে হাহাকার করেছে, ‘‘পাড়ার লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। এক জনও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। কোলে নিয়ে দৌড়োচ্ছি। মেয়েটি কোল থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। তবু এক পা এগোননি কেউ!’’
শুনে আমি স্তম্ভিত। ‘আমরা’ থেকে কবে শুধুই ‘আমি’ হয়ে গেলাম সবাই? নিজের ভাল ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না। নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পা চলি না। নিজের দল, নিজের লোক ছাড়া কারওর কথা বলি না। শুনিও না। এই রোগও ভীষণ সংক্রামক। গায়ে গা ঘেঁষার আগেই দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ছে এক জনের মন থেকে অন্য জনের মনে! সবাই বলবেন, আমি শ্রীলেখা মিত্রও তো একচোখোমিতে ওস্তাদ। খালি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের দলের গুণগান করি। সবটা মেনে নিয়েই বলছি, আমার পাশের বাড়ির ছেলেটি কট্টর তৃণমূল। ওকে কিন্তু কোনও দিন বাম দলের সঙ্গে জড়াইনি। আমার কোনও পোস্টের সঙ্গেও নয়। ছেলেটিও শাসকদল আর বাম দলের নীতিগত ফারাক নিয়ে আলোচনায় বসেনি। তার পরেও আমফানের সময় গোটা পাড়া যখন বিদ্যুৎহীন, আমি আর সেই ছেলেটি মাঝ রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করিয়েছি। একবারও মনে হয়নি, কার জন্য করছি? কেন করছি?
অতিমারি জীবন ধ্বংস করছে। স্বার্থপরতা নষ্ট করছে মন। সৃষ্টি রসাতলে যেতে আর বোধহয় বেশি বাকি নেই।