Soumitra Chatterjee

সৌমিত্রকাকুকে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা

সত্যজিতের মানসপুত্রকে নিয়ে লিখলেন সত্যজিৎ-পুত্র।দু’জনের মধ্যে কেমন যেন পিতা-পুত্রের সম্পর্কই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

Advertisement

সন্দীপ রায়

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ১৩:০৯
Share:

দু’জনের মধ্যে কেমন যেন পিতা-পুত্রের সম্পর্কই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘ঘরে বাইরে’ ছবির সেটে।

চারুলতাকে অমল চিঠি লিখবে। শ্যুট চলছে ‘চারুলতা’-র। বাবা (সত্যজিত্ রায়) গম্ভীর গলায় সৌমিত্রকাকুকে বললেন, “তোমার এই হাতের লেখায় হবে না। সেই সময়ের হাতের লেখার মতো করে চিঠি লিখতে হবে।” এর পর বাবা হাতে ধরে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়েছিলেন সৌমিত্রকাকুকে। খুব মন দিয়ে তখন দেখেছিলাম ‘চারুলতা’ ছবির অমল সেই হাতের লেখা রপ্ত করলেন। পরবর্তীকালে খেয়াল করে দেখলাম, সৌমিত্রকাকুর হাতের লেখাটাই বদলে গেল! ‘অমল’এর মতো করেই লিখতে শুরু করলেন।

Advertisement

এমন-ই ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি— সব কিছু প্রথম থেকেই অসাধারণ ছিল, ওঁকে কোনও চেষ্টাই করতে হয়নি, তা কিন্তু একেবারেই নয়। ‘অপুর সংসার’-এর সময় বাবা বলতেন, ওঁর গলার আওয়াজ বড্ড পাতলা। ও মা! সেই সৌমিত্রকাকু একজন দক্ষ আবৃত্তিকার হয়ে উঠলেন! এই যে নিজেকে তৈরি করার বিষয়টা, এটাই আমায় আশ্চর্য করত। গলার আওয়াজ নিয়ে নানা চর্চা, বিভিন্ন দিকে তাঁর শ্রম তাঁকে কেবলমাত্র একজন অভিনেতা নয়, একজন শিল্পী হয়ে ওঠার দিকে নিয়ে গেল! নিজের সঙ্গে নিজের চ্যালেঞ্জ ছিল ওঁর। কিছু হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ।

বাবার স্নেহ, নির্ভরতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্রকাকুও। ‘অশনি সংকেত’ ছবির সেটে দু’জনে।

Advertisement

৬০ বছরের যোগাযোগ ওঁর সঙ্গে। চলচ্চিত্রের জন্য তো আসতেনই। যখন থেকে ‘এক্ষণ’ প্রকাশিত হল, তখন থেকে আমাদের বাড়িতে ওঁর আসা বেড়ে গেল। বাবা ‘এক্ষণ’-এর নামকরণ করে দিলেন। কভারও এঁকে দিলেন। বাবা যখন ওঁকে চিত্রনাট্য হাতে দিতেন, তখন দেখেছি উনি সেই চিত্রনাট্যের ওপরও কাজ করতেন। মানে, সংলাপগুলো স্ক্যান করে নিতেন। হয়তো চা খাওয়ার দৃশ্য আছে। কোন সময়ে চায়ে চুমুক দেবেন, সেটাও ওঁর লেখা থাকত। জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে শার্টের কোন হাতা আগে গোটাবেন, সেটাও ফুটনোটে থাকতো। আমার মনে হয় ওঁর অসম্ভব স্মৃতিশক্তিও বাবাকেও মুগ্ধ করেছিল। ‘ঘরে বাইরে’-র শ্যুট চলছে। ‘সন্দীপ’-এর সেই প্রথম বক্তৃতা। ওই বড় চাঙ্ক দ্রুত মুখস্থ করে ফেললেন। শুধু তা-ই নয়, ডাবিংয়ের সময় ওয়ান টেকে ‘ওকে’ হয়ে গেল! এই ডেডিকেশন আর পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন: আমার প্রথম নায়ক

বাবার মোট ২৭টা ছবির ১৪টায় প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্রকাকু। শুধু যে ছবিতে অভিনয় করলেন আর চলে গেলেন, বিষয়টা এমন ছিল না। আমাদের পরিবার, ইউনিট সব কিছুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকতেন। স্পটবয় থেকে ক্যামেরাম্যান— সকলের সঙ্গে গল্প করতেন শ্যুটিং ফ্লোরে। বাবাও আলাদা করে ভাবতেন ওঁকে নিয়ে। ‘অপুর সংসার’-এর পর বাবা বলেছিলেন, “‘আমার এ ছবিতে তোমার কাজ যা হয়েছে, তাতে লোকজন তোমায় কাজ দেবে। তবুও যদি কাজ না-পাও, আর কিছু না হোক, তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে তো কাজ করতেই পারো।’’

অনেকেই বাবাকে সৌমিত্রকাকুর ‘মানসপিতা’ বলেন। আর সৌমিত্রকাকুকে বাবার ‘মানসপুত্র’।

পরিচালক আর অভিনেতার ওই নির্ভরতা দেখে আমারও মনে হত, দু’জনের মধ্যে কেমন যেন পিতা-পুত্রের সম্পর্কই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

সৌমিত্রকাকুর ছবি সব সময় বাবার কাছে থাকত। যখনই যে চরিত্রে তাঁকে ভাবতেন, মেকআপের জন্য ওই ছবির ওপরই আঁকাআঁকি শুরু করে দিতেন। বিশেষ ধরনের মেকআপের জন্য, যেমন ‘অশনি সংকেত’-এ সৌমিত্রকাকুকে নিজের সামনে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা। বাবার এই স্নেহ, নির্ভরতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্রকাকুও।

‘অশনি সংকেত’-এর সময় ওঁকে নিয়ম করে ডায়েরি লিখতে দেখেছি। পরে কতবার বলেছি ওটা খুঁজে বার করুন। জানি না সেই ডায়েরি এখন কোথায়!

‘অশনি সংকেত’-এর সময় আমি দেখেছি, নিয়ম করে ওঁকে ডায়েরি লিখতে। পরে কতবার বলেছি ওই ডায়েরি খুঁজে বার করুন। জানি না সেই ডায়েরি এখন কোথায়! ‘অপু’ ছাড়া ‘অশনি সঙ্কেত’-এর ‘গঙ্গাচরণ’ ছিল ওঁর সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। ওই ছবির শ্যুটের সময় সারাক্ষণ উনি শ্যুটিং স্পটে। একদিন এমনও হয়েছিল, যে লম্বা ট্রলির শ্যুট। সে দিন লোক কম। ও মা! উনিই দেখলাম ট্রলি টানতে শুরু করলেন। বাবা বলে উঠলেন, “তোমরা হিরোকে দিয়ে ট্রলি ধরার কাজ করালে!” এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন সৌমিত্রকাকু। আমাদের ইউনিট মানেই ওঁর কাছে পরিবারের সঙ্গে থাকা।

উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি, কিন্তু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র

এখনও ভুলতে পারি না ৩০ সেপ্টেম্বরের কথা। সৌমিত্রকাকুকে নিয়ে আর্কাইভ হচ্ছে খুব সম্ভবত। ওঁর মেয়ে পৌলমী করছে। ও-ই বলল, এটা শ্যুট হবে। আমি আর বেণু (সব্যসাচী চক্রবর্তী) সৌমিত্রকাকুর ছবির কাজ নিয়ে ওঁকেই প্রশ্ন করব। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োয় পৌঁছে দেখি উনি সকাল থেকে শ্যুট করছেন। আমাদের শেষ পর্যায়ে কাজ ছিল। আমি আর বেণু মেক আপ রুমে অপেক্ষা করছি। ভাবলাম, একটু জিরিয়ে নিন সৌমিত্রকাকু। তার পর আমরা ফ্লোরে যাব। দেখি উনি নিজেই চলে এলেন। বললেন, ‘‘তোমরা এখানে কেন? চলো শুরু করি।’’ ওই বয়সে সকাল ১১টা থেকে কথা বলে চলেছেন। মুখে মাস্ক নেই! চমকে উঠেছিলাম!

মাস্ক নেই কেন সৌমিত্রকাকু?

‘‘আমার ৮৫ বছর হয়ে গেল! আমার আর মাস্ক পরে কী হবে? নতুন করে কী আর সচেতন হব? ধুর!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement