ওঁর বায়োপিক করার সুবাদে সম্প্রতি আমরা একে অপরের ভীষণ কাছাকাছি এসেছিলাম। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
বছর দুয়েক আগের কথা। একটা ছবির শ্যুটিং চলছে। হাসপাতালের সেট। একটা দৃশ্যে সৌমিত্রজেঠু আর আমি। সেই সময় ওঁর একার শট। সিনেমার পরিভাষায় আমরা যাকে ‘ক্লোজ আপ’ বলি। জেঠুর শট হয়ে যাওয়ার পর আমার পালা। আমি ওই ঘরেই অপেক্ষা করছি। শটটা শেষ হওয়ার পর পরিচালক জেঠুকে উপরে গিয়ে খেয়ে নিতে বললেন। উনি চলেও যাচ্ছিলেন। আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘পরম, যাবি না?’’
আমি বললাম, ‘‘তুমি যাও। আমি শটটা দিয়েই আসছি।’’
ঘাড়টা একটু দুলিয়ে জেঠু আমাকে বললেন, ‘‘ঠিক আছে।’’ তার পর পরিচালকের উদ্দেশে, ‘‘আসলে আমাদের এই বায়োস্কোপ লাইনে কথা বলার মতো লোক তো বড় একটা পাওয়া যায় না। তাই পেলে ভাল লাগে।’’ তার পর আমার দিকে তাকিয়ে, ‘‘তুই আয় তা হলে, আমি অপেক্ষাই করি।’’
এত কিছুর মধ্যে সৌমিত্রজেঠুর ওই কথাগুলো আজ বড্ড বেশি কানে ভাসছে।
আরও পড়ুন: আমার প্রথম নায়ক
সৌমিত্রজেঠুর বায়োপিক ‘অভিযান’ করার সুবাদে সম্প্রতি আমরা একে অপরের ভীষণ কাছাকাছি এসেছিলাম। শ্যুটিং শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারির শেষে। কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে আমরা বসছিলাম। সেই বসাগুলোর মধ্য দিয়েই অনেক অনুভূতি কুড়িয়ে নেওয়া আমার। সব থেকে ভাল লাগত জেঠুর সঙ্গে কাটানো সেই সব সন্ধেগুলো। খুব এনজয় করতাম।
সিনেমায় কাজ করাটা ভীষণ ভালবাসতেন। কিন্তু তা থেকে সৃষ্টির যে তৃপ্তি, সেটা তিনি পেয়েছেন বলে মনে হয়নি। ছবিতে ‘শ্রাবণের ধারা’ ছবিতে সৌমিত্রজেঠুর সঙ্গে আমি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনকে আধার করে একটা ছায়াছবি বানাব, এ স্বপ্ন যে আমি দীর্ঘদিন ধরে দেখেছি, এমনটা নয়। এই বায়োপিকের প্রযোজক প্রথম আমায় প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। সৌমিত্রজেঠুর ঘনিষ্ঠ একজনও আমাকে একই কথা বলেন। সেই থেকে আমার ভাবনা শুরু।
ঠিকই করেছিলাম, পুজো-অর্চনা করার মতো করে বায়োপিক বানাব না। একজন শিল্পীকে ও ভাবে ধরাটাও ঠিক নয়। কোনও লাভ হয় না তাতে। আসলে সৌমিত্রজেঠুকে নিয়ে আমার নিজস্ব একটা বীক্ষণ ছিল। দেখা ছিল। বোঝা ছিল। বোধও ছিল। প্রস্তাবটা পাওয়ার পর ১৪-১৫ বছর ধরে লালিত সেই বোধগুলোকে একটু নাড়াঘাঁটা করি।তাঁর গদ্যসংগ্রহ পড়ি। তার পর ওঁর সঙ্গে কথোপকথন শুরু। আসলে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এক জন মানুষকে বেশি চেনা যায়। একটা মানুষকে তো পুরো চেনা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে দেখলাম, দূর থেকে সৌমিত্রজেঠুকে যে ভাবে চিনতাম, সেই চেনাগুলো অনেকটাই ঠিক। তার বাইরেও একটা পরিধি থাকে। সকলেরই। ওঁরও ছিল। ছবিটা বানাতে গিয়ে সেই অচেনা খোপগুলো অনেকটাই খোলসা হয়েছে।
আরও পড়ুন: উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি, কিন্তু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র
আসলে আমাদের সকলের মধ্যেই অনেকগুলো সত্তা কাজ করে। সেই সত্তাগুলোকে আপন করে নিতে খুব কম মানুষ পারেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে শুধু একজন অভিনেতা, একজন কবি, একজন নাট্যকার, একজন গদ্যকার— এমন ভাবে দেখলে চলবে না। উনি সেটা ছিলেন না। উনি সার্বিক ভাবে একজন শিল্পমনস্ক মানুষ। শিল্পের যে সঙ্কটগুলো পৃথিবীতে রয়েছে, শিল্পের যে দোলাচল মানুষকে ভাবায়— সেটাই একজনকে শিল্পী করে তোলে। সৌমিত্রজেঠু আবার সরলরৈখিক শিল্পীও ছিলেন না। উনি অভিনয় করতেন, নাটক লিখতেন, কবিতা লিখতেন, পাঠ করতেন, গদ্য লিখতেন, বামপন্থায় ঝোঁক ছিল— এমন সরলরেখায় ওঁকে না বাঁধাই ভাল। আসলে শিল্পীরাও তো মানুষ। রসায়নশাস্ত্রের সেই ক্ষার-ক্ষারকের সম্পর্কের কথা ধার করে বলতে পারি, সব শিল্পীই মানুষ, কিন্তু সব মানুষ শিল্পী নন। একজন শিল্পীই পারেন আমাদের ভিতরের সমস্ত সত্তার মুখোমুখি হতে। ভাল-মন্দ মেলানো-মেশানো সেই সত্তাগুলোকে নিজের ভিতর থেকে খুঁজে বার করে, সেগুলোকে চিনতে পেরে, সেগুলোর কাছে নতি স্বীকার করে, বুঝতে পেরে বিভিন্ন সময়ে শিল্পের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে তো একমাত্র শিল্পীই পারেন। সেই জায়গা থেকে আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমি একজন শিল্পী বলে মনে করি। উনি ভাল অভিনেতা বা ভাল কবি বা ভাল গদ্যকার বা ভাল পাঠ করেন বা ভাল বামপন্থী— বোকার মতো এ সব আলোচনায় গিয়ে ওঁর শিল্পীসত্তাকে বিচার করাটা মূর্খামি হবে।
‘অভিযান’-এ আমি এটারই একটা ছোঁয়াচ রাখার চেষ্টা করেছি। বায়োপিকে উনি সেই ধরা দেওয়ায় কোনও আপত্তি করেননি। আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ থেকে কিছু জিনিস সরিয়ে রেখেছিলাম। আসলে আমি যতটা ভেবেছিলাম, সেটে পৌঁছে বুঝলাম, সৌমিত্রজেঠুর আরও আরও সত্তা ছিল। সেটার খোঁজ কেউ পায়নি।সেই সত্তাগুলোর অনেকটা সন্ধান আমি পেয়েছিলাম। কিছু সত্তা সাঙ্ঘাতিক সুন্দর। কিছু একেবারেই সুন্দর নয়। ‘অভিযান’-এ সে সব আছে।
ওঁর চোখের কোণ চিকচিক করছে। আমার চোখেও জল। শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ওই মুহূর্তটা রচিত হয়ে যেত। কখন, কী ভাবে, তা দু’জনের কেউই টের পেতাম না। ছবি ‘অভিযান’-এর শ্যুটিংয়ের ফাঁকে।
সৌমিত্রজেঠুসম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হল, একটা সময়ের পর সিনেমা-জীবনটা ওঁর কাছে আর উত্তেজক ছিল না। তেমন কোনও চড়াই-উৎরাইও হয়নি। উনি সিনেমায় অভিনয়টাকে পেশা বলেই মনে করতেন। রোজগারের একটা উপায় বলেই ভাবতেন। শৈল্পিক ভাবে সিনেমা আর ওঁকে ততটা অনুপ্রাণিত করেনি। আমি বায়োপিকেও সেটা রেখেছি। চেষ্টা করেছি, নব্বইয়ের দশকের সেই সময়টার পর থেকে সৌমিত্রজেঠুর অন্য যে বোধগুলো আরও বিকশিত হয়েছে, সেগুলোকে ধরতে। তবে সিনেমায় কাজ করাটা ভীষণ ভালবাসতেন। কাজ না থাকলে ছটফট করতেন। কিন্তু তা থেকে সৃষ্টির যে তৃপ্তি, সেটা তিনি পেয়েছেন বলে মনে হয়নি।
আমাকে অনেকে উন্নাসিক ভাবেন। প্রথম দিকে আমার খুব অসুবিধা হত এটা শুনে। কিন্তু সৌমিত্রজেঠু ওইযে কথাটা বলেছিলেন, ‘আমাদের এই বায়োস্কোপ লাইনে কথা বলার মতো লোক তো বড় একটা পাওয়া যায় না। পেলে ভাল লাগে’, তার পর থেকেআমার আর অসুবিধা হয় না। আসলে শিল্প নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করার মতো লোক খুব কমে গিয়েছে। আমি সৌমিত্রজেঠুর সঙ্গে কাটানো ওই সন্ধেগুলো খুব মিস্ করি। আর কখনও অমন সময় কাটানো হবে না আমাদের। সিনেমা, রাজনীতি, নাটক, সাহিত্য— সব কিছু নিয়েই আলোচনা।
আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকুকে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা
একটা সন্ধের কথা বলি। আমি কিউবা ঘুরেছি।যদিও সে দেশে কেউ খুব একটাঘোরার জন্য যায় না। তো জেঠুকে যখন বললাম, কিউবা ঘুরে এসেছি, উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী দেখলি ওখানে?’’ আমার সবটা দেখা জেঠুকে শুনিয়েছিলাম। শেষে বলেছিলাম, ‘‘জানো জেঠু, আমার মনে হয়, উত্তমকুমার বাংলা সিনেমারচে গেভারা আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হচ্ছেনফিদেল কাস্ত্রো।’’ জেঠুবললেন, ‘‘কেন? এমনটা কেন মনে হয় তোর?’’ আমি বললাম, ‘‘দেখো, উত্তমকুমার যখন তাঁর খ্যাতি ও সাফল্যের চূড়ায়, তখন মারা গিয়েছিলেন। ফলে তাঁর সেই নায়ক ইমেজটা থেকে গিয়েছে। তাঁকে আর অন্য কিছুর মুখোমুখি হতে হয়নি। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই দশা, সিরিয়াল—দেখতে হয়নিকোনও কিছুই। ঠিক যেমন রাজনীতিতে চে। আর ফিদেল? তাঁকে কত কিছু দেখতে হয়েছে। রাজনীতির পঙ্কিল অধ্যায় তো তাঁকেই কাটাতে হয়েছে। ঠিক তোমার মতো। আসলে দীর্ঘ জীবন তোমায় আর ফিদেলকে এটা দেখিয়ে দিয়েছে। তাই উত্তমকুমার আমার কাছে বাংলা সিনেমার চে, আর তুমি ফিদেল।’’
জেঠু হো হো করে একেবারে সশব্দে হেসেছিল অনেক ক্ষণ।
‘অভিযান’-এর জন্য কাটানো সেই সব সন্ধেয় এমন অনেক মুহূর্ত আসত, যখন আমরা দু’জনেই নীরব হয়ে যেতাম। বেশ কয়েক মিনিট পর নৈঃশব্দ্য ভাঙতেন সৌমিত্রজেঠু। তখন দেখতাম, ওঁর চোখের কোণ চিকচিক করছে। আমার চোখেও সেই মুহূর্তে জল। আসলে শিল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ওই মুহূর্তটা রচিত হয়ে যেত। কখন, কী ভাবে, তা দু’জনের কেউই টের পেতাম না।
সে কারণেই আজ কেবলই কানে ভাসছে, ‘‘তুই আয় তা হলে, আমি অপেক্ষাই করি।’’ কোনও অপেক্ষাই যে আর রাখলে না, সৌমিত্রজেঠু!