Nepotism

স্বজনপোষণ নিয়ে কী বললেন বাংলার শিল্পীরা?

সুরকারের দাদাগিরি থেকে সরকারি পর্যায়ে লবিবাজি—এমন হাজারো অভিযোগ সুরের আঙিনায়

Advertisement

দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২০ ০১:০২
Share:

লোপামুদ্রা, রাঘব, ইমন ও ঋদ্ধি

নাম ছাপা হয়ে গিয়েছিল বিজ্ঞাপনে কিন্তু মূল অনুষ্ঠানে বাদ পড়েছেন। রিহার্সাল হয়ে গিয়েছে, রেকর্ডিংয়ের আগেই শুনলেন, গানটা গাইবেন অন্য কেউ... এমন ঘটনা মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি ইটের ভাঁজে। যে কারণে নেপোটিজ়ম কিংবা ফেভারিটিজ়মের প্রসঙ্গে উঠলে অধিকাংশ শিল্পীই বলেন, ‘এ আর এমন কী?’

Advertisement

শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র প্রশ্ন তুললেন, ‘‘এটা কোন ইন্ডাস্ট্রিতে নেই? আমাদের সবটা মেনে নিয়েই চলতে হয়। এখন খুব সহজে বলছি বটে, কেরিয়ারের শুরুর দিকে কান্না পেত। আমি কোনও দিন কারও ‘স্বজন’ হতে চাইনি বলেই, লড়াইটা আরও কঠিন হয়েছিল।’’ কাজ পেতে গেলে যে, অতিরিক্ত পিআর করতে হয় কিংবা ‘ঘনিষ্ঠতা’, তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করছেন গায়িকা। তার সঙ্গে এ-ও মনে করেন যে, এ ভাবে বেশি দিন চালানো যায় না, প্রতিভারও দরকার। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, নিয়মিত প্লেব্যাকও করে থাকেন, তা সত্ত্বেও রাস্তাটা মোলায়েম ছিল না ইমন চক্রবর্তীর। ‘‘খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে আমার নাম বেরিয়ে গিয়েছে। তার পরে শুনলাম অনুষ্ঠানে আমি গাইব না। আমার চেয়েও গুণী ও সিনিয়র শিল্পীর সঙ্গে এটা হয়েছে। অমুকের মেয়ের বা ছেলের যদি প্রতিভা থাকে আর সে সুযোগ পায় তাতে আপত্তির কিছু দেখি না। যেমন আলিয়া ভট্ট। কিন্তু যোগ্যতা নেই, তাও খুঁটির জোরে কেউ সুযোগ পাচ্ছে দেখলে গায়ে লাগে বইকি,’’ স্পষ্টবক্তা গায়িকা। বঞ্চনার দলিল খুলে দেখাতে চান না ইমন। বললেন, ‘‘পায়ের তলার মাটিটা আরও শক্ত হোক। তার পর নিশ্চয়ই বলব।’’

স্বজনপোষণ নিয়ে অতীতে বহুবার গলা তুলেছেন রাঘব চট্টোপাধ্যায়। বলছিলেন, ‘‘প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হয় না। নাম করে বললে কি তিনি আমাকে গাওয়ার সুযোগ দেবেন? এমনিতেও দেবেন না, অমনিতেও দেবেন না।’’ বেসিক গানের শিল্পীদের দিয়ে প্লেব্যাকে অনীহা রয়েছে টলিউডের সুরকারদের। ‘‘কেন এই বিভাজন তা বুঝি না! আর একটা ব্যাপার হল, নামের পাশে ‘মুম্বই’ ছাপ পড়তে হবে। তবে এখানে কল্কে পাওয়া যাবে, বেশি টাকা পাওয়া যাবে। এমন অনেক গান মুম্বইয়ের শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো হয়, যেটা বাংলার অনেকেই পারতেন,’’ লোপামুদ্রার গলায় ক্ষোভের সুর।

Advertisement

আরও একটি অভিযোগ নিয়মিত ওঠে মিউজ়িক ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে, গায়ক বদলের। ‘লগে রহো মুন্নাভাই’-এর জন্য রাঘবকে দিয়ে শান্তনু মৈত্র একটি গান রেকর্ড করান। পরে ছবির প্রযোজক সেই গান বাতিল করে রিয়্যালিটি শোয়ের উঠতি তারকাকে দিয়ে গাওয়ান। ‘‘খারাপ লেগেছিল কিন্তু এগুলো আমাদের সয়ে গিয়েছে। আবার উল্টোটাও ঘটেছে। ঋতুদা (ঋতুপর্ণ ঘোষ) মুম্বইয়ের নামী শিল্পীর গান বাদ দিয়ে আমার গলা ব্যবহার করেছিলেন ‘রেনকোট’ ছবিতে। অনুপমের (রায়) সুরে ‘যদি কেড়ে নিতে বলো’ আমার গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রূপম (ইসলাম) গাইল। কার নির্দেশে এটা হল, সে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। এ সব নিয়ে ভাবতে বসলে ডিপ্রেশন হয়ে যাবে,’’ বললেন রাঘব।

গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে অনুপম রায় এখন একটা বড় নাম। এক অনুষ্ঠানে বাবুল সুপ্রিয় মজার ছলেই বলেছিলেন, ‘অনুপম নিজেই তো সব গান গেয়ে নেয়।’ স্বজনপোষণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বিতর্ক বাড়াতে চান না অনুপম। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে নতুনদের সুযোগ দেওয়ার দায়িত্বটাও কি চলে আসে না? ‘‘আমি কিন্তু নতুনদের সুযোগ দিয়েছি,’’ ছোট্ট জবাব শিল্পীর। অনুপমের সুরে লগ্নজিতা চক্রবর্তী, ইমন চক্রবর্তী, ঈশান মিত্রর মতো নতুনরা প্লেব্যাক করেছেন। আর এক গায়ক-সুরকার অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আমরা সব সময়েই অন্য রকম কিছু খুঁজি। ‘কোন গোপনে’ গানটা আমি সুরঙ্গনাকে দিয়ে গাওয়ালাম। ও অনেক দিনের পরিচিত, তাই জানতাম পারবে। কেউ বলতেই পারেন, আমি কি আরও খুঁজতে পারতাম না? আসলে এই খোঁজটা চলে নিজস্ব ডেটাবেস থেকে। এটাকে তো স্বজনপোষণ বলা যায় না!’’

প্লেব্যাক না করলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না, সে কথা মানেন না রাঘব। ‘‘লোপামুদ্রা কিংবা নচিকেতাকে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য সিনেমার গানের অপেক্ষা করতে হয়নি,’’ গায়কের সাফ কথা। একই সুর শিল্পী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও। ‘‘সঙ্গীত পরিচালককে খাতির করে কাজ পেতে আমার অনীহা আছে। সোজাসাপ্টা কথা বলার জন্য আমাকে ‘ব্যান’ করা হবে এমন হুমকিও শুনতে হয়েছে,’’ মন্তব্য ঋদ্ধির। ইন্ডিপেন্ডেন্ট গায়ক হিসেবে বেশ কিছু নাম ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নিয়েছে। তিমির বিশ্বাস তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ব্যান্ড ফকিরার সদস্যও তিনি। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবির ‘আমার ভুল হয়েছে প্রিয়’ বা ‘আমার এটুক শুধু চাওয়া’ সেই পরিচিতি আরও বাড়িয়েছে। যদিও তিমির বললেন, ‘‘ওই গানগুলো আমাকে আলাদা করে সুযোগ করে দিয়েছে এমন নয়। মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য আমি নিজের মতো স্ট্রাগল করে যাচ্ছি। কেউ আমাকে সুযোগ দেবে, সেই আশায় বসে নেই।’’

স্বজনপোষণের অভিযোগ রয়েছে ইন্ডাস্ট্রির বেশ কিছু নামী সঙ্গীত পরিচালকের বিরুদ্ধে। ‘‘নাম করব না, কিন্তু এক সঙ্গীত পরিচালক এখন বড় ব্যানারের ছত্রচ্ছায়ায় বসে শিল্পীদের উপরে ছড়ি ঘোরান। তাঁর উত্থানের সময়ে যাঁদের অবদান ছিল, তিনি এখন তাঁদের চিনতেও পারেন না,’’ মন্তব্য রাঘবের। ‘‘সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়া নিয়েও লবিবাজি আছে,’’ বক্তব্য ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অভিযোগ, সরকারি অনুষ্ঠানে কারা সুযোগ পাবেন, তা ঠিক করেন রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত এক সঙ্গীত শিল্পী।

নামী গায়ক-গায়িকাদেরও ফেভারিট থাকে, অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রভাব খাটান। একটা সময়ে নচিকেতা-লোপামুদ্রা অনেক শো করেছেন। কিন্তু মনোমালিন্যের কারণে দীর্ঘ আট বছর লোপামুদ্রার সঙ্গে শো করতে চাননি নচিকেতা। ‘‘কোনও একটা ব্যাপারে নচিদার খারাপ লেগেছিল। তার পর থেকে দু’জনে শো করিনি। আমার বদলে উদ্যোক্তাদের অন্য এক গায়িকাকে নিতে বলতেন নচিদা। আবার উদ্যোক্তারা আমাকে নেবেন বলে নচিদাকে বাদ দিয়ে ‘ভূমি’কে নিয়েছেন। নচিদার সঙ্গে এখন ভুল বোঝাবুঝি নেই। ওঁকে কোনও দিন অশ্রদ্ধাও করিনি,’’ স্মৃতিকাতর লোপামুদ্রা।

অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগের খেলা যেমন চলবে, পছন্দের লোকেদের সুযোগ দেওয়ার ঘটনারও বদল হবে না। তবে শিল্পীদের কথাতেই স্পষ্ট, প্রতিভা না থাকলে কোনও ‘পোষণ’ই দীর্ঘ দিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement