এ ছবির আসল বাঘ পঙ্কজ ত্রিপাঠীই! প্রথম দৃশ্য থেকে ছবির পুরো দায়িত্ব তিনি নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন। ছবি ভিডিয়ো থেকে নেওয়া।
সৃজিতের (মুখোপাধ্যায়, পরিচালক) ‘শেরদিল’ দেখতে একটু দেরি হয়ে গেল। কিন্তু ছবিটা শুরু করেই বুঝলাম, না দেখলে বড় মিস্ করতাম। ছবির শুরুটাই এমন শক্তিশালী যে দর্শকের কৌতূহল তৈরি হবেই। পিলিভিট অঞ্চলের বাস্তব কাহিনির উপর ভিত্তি করেই গল্প বুনেছে সৃজিত। এক গ্রামের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তাঁরা তাঁদের গ্রামের বৃদ্ধদের জঙ্গলে ফেলে আসে, যাতে বাঘের সঙ্ঘাতে তাঁদের প্রাণ গেলে তাঁরা সরকারি ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। সে গ্রামের বৃদ্ধরা অবশ্য জানিয়েছিলেন, তাঁরা স্বেচ্ছাতেই জঙ্গলে যান, যাতে সরকারি টাকায় তাঁদের পরিবারের পেট চলে। এক মাত্র সৃজিতই এই ঘটনা ঘিরে চিত্রনাট্য লেখার কথা ভাবতে পারে!
ছবির প্রথম দৃশ্যেই বোঝা যায় গল্পে কতটা দম রয়েছে। সরকারি আধিকারিকের সঙ্গে গঙ্গারামের (পঙ্কজ ত্রিপাঠী) অদ্ভুত কথোপকথন শুনেই দর্শক নড়ে বসবেন। বাঘে না খেলে আর কোনও সরকারি প্রকল্প থেকেই যে দরিদ্র গ্রামবাসীদের জন্য টাকা পাওয়া যাবে না, তা পরিষ্কার হয়ে যায় প্রথম কিছু দৃশ্যেই। আরও একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়।
প্রথম দৃশ্য থেকে ছবির পুরো দায়িত্ব পঙ্কজ ত্রিপাঠী নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন।
এ ছবির আসল বাঘ পঙ্কজ ত্রিপাঠীই! প্রথম দৃশ্য থেকে ছবির পুরো দায়িত্ব তিনি নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন। এবং প্রত্যেকটা দৃশ্যে তিনি যে ভাবে অক্লেশে অথচ নিষ্ঠাভরে অভিনয় করে গিয়েছেন যে, গল্প এগিয়েছে তাঁরই প্রত্যেকটা সংলাপ, ছোটখাটো অভিব্যক্তি এবং শরীরী ভাষায় উপর ভরসা করে। যে অভিনেতা শুরু করেছিলেন ছোট ছোট পার্শ্বচরিত্র করে, এখন তাঁর উপরেই বাজি ফেলে একটা গোটা ছবি বানিয়ে ফেলা যায়, ভাবতেও ভাল লাগে।
তবে আরও দু’জনের কথা না বললেই নয়। গঙ্গারামের স্ত্রী লাজোর ভূমিকায় সায়নী গুপ্ত এবং জিম আহমেদের ভূমিকায় নীরজ কবি। এত শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রী এখন কলকাতায় পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে! সায়নীকে আমি প্রথম ভাল করে লক্ষ করেছিলাম ‘আর্টিক্ল ১৫’-এ। ওই ছবিতেও যতটা মনে দাগ কেটেছিল ওর অভিনয়, এ বার যেন আরও ছাপিয়ে গেল। ড্রেডলকওয়ালা চোরাশিকারির চরিত্রে নীরজ কবিকে বাছাটাও সৃজিতের আরও এক মাস্টারস্ট্রোক। চোরাশিকারির সঙ্গে কোথাও যেন কবি-দার্শনিক মিলেমিশে এক হয়ে যায়। তাই নীরজও অনায়াসে মানিয়ে যান এই চরিত্রে। আমরা সাধারণত একটা লোকের শিক্ষা-পেশা দিয়েই তাঁকে মাপি। অথচ এই আপাতদৃষ্টিতে ‘খারাপ লোক’গুলোরই কত জ্ঞান হতে পারে, তা বুঝিয়ে দেয় জিম আহমেদের চরিত্র। সৃজিতের লেখা এই চরিত্র যেন আমাদের সভ্যতাকে সপাটে একটা চড় মারে।
গঙ্গারামের স্ত্রী লাজোর ভূমিকায় সায়নী গুপ্তর অভিনয় নজরকাড়া।
গল্পের উপস্থাপনা খুব ভাল। গত বছর একই সময় বোধ হয় মুক্তি পেয়েছিল জঙ্গল ঘিরে আরও একটি ছবি ‘শেরনি’। এই ছবির প্রথমাংশের চিত্রগ্রহণ হয়তো সেই ছবির কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। তবে গল্প একটু এগোতেই বোঝা যায়, এই ছবি ‘শেরনি’ পথে হাঁটেনি। শুরুতে এক রকম মনে হলেও, পরে গল্পটা অন্য রকম হয়ে যায়। কিছু কিছু জায়গায় হয়তো গল্পের গতি যে ভাবে শ্লথ হয়েছে, তাতে দর্শকের উৎসাহ হারিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সৃজিত সেটা হতে দেয়নি। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও সেই জায়গাগুলো সামলে দিয়েছে।
ছবিটা কি স্যাটায়ার? না কি ব্ল্যাক কমেডি? না কি আমাদের সমাজকেই তথ্যচিত্রের মতো করে তুলে ধরা? চিত্রনাট্য যত এগিয়েছে, ততই দর্শকের মনে আরও নতুন নতুন প্রশ্ন আসা-যাওয়া করেছে। একটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই অন্য নতুন একটা প্রশ্ন তৈরি হয়ে যায়। সৃজিত অবশ্য স্পষ্ট করে কোনওটারই উত্তর দিতে চায়নি। আর সেখানেই ও বোধহয় জিতে গিয়েছে।