সভাগৃহের বাইরে জ্বল জ্বল করছে সৌমিত্রের স্মৃতি।
‘শোক নয় আর, উদযাপন রাখি, কান্নাও নয়, ওড়াই স্মৃতির পাখি, দীর্ঘশ্বাস দূরে থাকুক, আস্তে বলি ভালবাসার কথা, মিলিয়ে যাক, বিলিয়ে যাক সে বাতাসে যেমন নীরবতা’-- এটাই ছিল শনিবার সন্ধেয় ‘শ্যামবাজার মুখোমুখি’ নাট্যদলের সংকল্প। সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই গান, আড্ডা, কবিতায় রবীন্দ্র সদনের মঞ্চ জুড়ে সভাসদ নাট্যব্যক্তিত্ব দেবশংকর হালদার, কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, পরিচালক অতনু ঘোষ, শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা মিত্র, উপল সেনগুপ্ত, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, রাঘব চট্টোপাধ্যায়, কবি শ্রীজাত, অভিনেতা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, সৌমিত্র মিত্র, বাচিক শিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য, বিলু দত্তের উপস্থিতি। ছিলেন মেয়ে পৌলোমী, ছেলে সৌগত, স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়। কারওর কাছে তিনি 'সৌমিত্র কাকু'। কারওর তিনি 'সৌমিত্রদা'। কারওর আবার 'ভীষণ সুপুরুষ বাবা'।
সভাগৃহের বাইরে জ্বল জ্বল করছে তাঁর নানা বয়সের, নানা সিনেমার বড় বড় স্থিরচিত্র। চত্বরে পরিপাটি করে সাজানো বিভিন্ন নাটকের সাজ-পোশাক।
থার্ড বেল পড়ার পরেও মঞ্চে রাজ সিংহাসন ফাঁকা-ই। ‘মুকুটটা পড়ে আছে’, ‘রাজা লিয়র’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধু নেই!
অনুষ্ঠানের শুরু শ্রাবণী সেনের রবীন্দ্রগানে। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মতোই জায়ান্ট স্ক্রিন দেখিয়েছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেবশংকর হালদার, কৌশিক সেনের অনস্ক্রিন কথপোকথন। তার পরেই মঞ্চে উপস্থিত একে একে রাজা লিয়রের পারিষদরা। তাঁদের স্মৃতিচারণ। যেমন, অতনু ঘোষ জানিয়েছেন কী ভাবে ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবিতে তিনি অভিনেতাকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। দেবশংকর জানালেন, অভিনয়ের পর সম্বর্ধনা হিসেবে পাওয়া ফুলের তোড়া দেখে কী আফসোস সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের, "ওগুলো যদি বক ফুল, কুমড়ো ফুল হত! বাড়িতে বড়া করে ভেজে তো খেতে পারতাম।" উপল শুনিয়েছেন একটি রাতের গল্প। ইংরেজি বছর শেষের সেই রাতটি তিনি উদযাপন করেছিলেন বন্ধু অমিত দাস আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শ্রীজাত মুগ্ধ সৌমিত্রের একই অঙ্গে কবি ও অভিনেতা সত্তার সহাবস্থানের সাক্ষী থাকতে পেরে।
পরিপাটি করে সাজানো বিভিন্ন নাটকের সাজ-পোশাক।
তার মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলেছেন 'রাজা লিয়র’ নাটকের পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়, "রাজা লিয়র-এর সময় প্রযুক্তির সব সুবিধা ছিল। তবু সৌমিত্রদার কোনও অভিনয়ের ভিডিয়ো রেকর্ডিং নেই। এটা অপরাধ।’’
আরও পড়ুন: শিরোপা ছিল সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায়, ছিলেন জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়, ‘চন্দ্রকান্তা’ এখন বিস্মৃত
স্মৃতিচারণের মধ্যেই ‘চোখ ভিজবে না’ বলেও গাল বেয়ে কান্না ঝরেছে পৌলোমী বসুর। মঞ্চে তখন শ্রীকান্ত আচার্য গাইছেন সৌমিত্রবাবুর পছন্দের গান 'এসো এসো আমার ঘরে এসো... আমার ঘরে।' যেমন অভিনেতা-কন্যার আফসোস ছিল, ‘‘বাপি তুমি এত সুন্দর কেন বলতো? কিছুতেই দেখতে খারাপ করা যাচ্ছে না!’’
আরও পড়ুন: কৃষকদের গরম কাপড়ের জন্য এক কোটি টাকা দিলেন দিলজিৎ
৬১ বছরের দাম্পত্যে সৌমিত্রের কট্টর সমালোচক ছিলেন স্ত্রী দীপা। একটি বিষয়েই তাঁর মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা, গাড়ি দারুণ ড্রাইভ করতে পারতেন ‘ফেলুদা’।
এ ভাবেই সবাই গান, কবিতা, আড্ডায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বেঁধে রাখলেন অনায়াসে। এঁদের কথায় আরও এক বার নতুন করে পরিচিত হলেন, বাঁধা পড়লেন অভিনেতা, কবি, স্বামী, বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।