একই সঙ্গে বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতে অনায়াস বিচরণ ছিল শিবকুমারের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
‘সানাই’-এর ক্ষেত্রে যে কাজটি করেছিলেন বিসমিল্লাহ, ‘সন্তুরে’ সেই কাজটিই করেছিলেন শিবকুমার শর্মা। ‘সন্তুর’ যন্ত্রটিকে ভিন্ন স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ‘সন্তুর’ বললেই যেন কল্পনার রংমশালে জ্যোতির্ময় সেই সুপুরুষ!
অথচ, একটা সময় পর্যন্ত সন্তুর শুধুমাত্র কাশ্মীর অঞ্চলের সুফি শিল্পীরাই ব্যবহার করতেন। জনশ্রুতি, ‘সুফিয়ানা মওসিকি’ বলে প্রসিদ্ধ এক বিশেষ ধরনের গায়কিতে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হত। এ হেন ‘সন্তুর’ যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্রের মর্যাদা লাভ করতে পারে, তা কল্পনা করেছিলেন শিবকুমারের বাবা উমা দত্তশর্মা। উমা ছিলেন প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর কাছেই তালিম নেওয়া শুরু করেন শিবকুমার। প্রথমে শেখেন তবলা। কিন্তু বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে এমন কিছু করুক, যাতে সে ‘ঝাঁকের কই’ না হয়। সেই ভাবনা থেকে ছেলেকে সন্তুর শেখানোর কথা মাথায় আসে তাঁর। অতঃপর, ‘সন্তুর’ যন্ত্রটিকে খানিক বদলে ফেলেন তিনি, সেই বদল করার ধারা দীর্ঘ দিন ধরে জারি রেখেছিলেন শিবকুমার।
বস্তুত, সন্তুরকে আমূল বদলে ফেলেন শিবকুমারও। যে যন্ত্রটি এখন দেখতে পাওয়া যায়, তার ৩১টি ব্রিজ এবং ৯১টি তার। উপরের দিকের তারগুলি লয় ধরে রাখার জন্য বিশেষ ধাঁচে বাজানোর শৈলী তৈরি করেন শিবকুমার। একই সঙ্গে ডান হাতে বাজতে থাকে যন্ত্রের নীচের দিকে সজ্জিত তারগুলি। ফলে মূল সুর এবং একটি লয়ে সুরমূর্ছনা জোছনার আলোর মতো মায়া তৈরি করে। মীড়ের অভাব বোধ হয় না। কখনও আবার হাতের আঙুল তারে স্পর্শ করে ভিন্ন শব্দ তৈরির প্রয়াসী হয়েছেন। এই যে বাজনার ধরন, তা-ই এই যন্ত্রটিকে তার পূর্বসূরির থেকে পৃথক করে তোলে। সেতার বা সরোদে যে ভাবে কোনও রাগ বাজানো হয়, সেই ‘আলাপ’, ‘জোড়’, ‘ঝালা’ বাজতে থাকে সন্তুরেও। এই ভাবেই সন্তুরকে সুফিয়ানা বাদ্যযন্ত্র থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অলিন্দে পৌঁছে দেন শিবকুমার। আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে সন্তুর তাঁর একার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়। সানাইয়ের ক্ষেত্রে অনুরূপ কাজ করেছিলেন ‘ভারতরত্ন’ বিসমিল্লা। একদা শুধু বিবাহ-অনুষ্ঠানে যে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হত, তা-ই হয়ে ওঠে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূল ধারার যন্ত্র। সেখানে ‘পুকার’, ‘সপাট তান’, তবলার ‘রেলা’-র সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তানের মতো বহু কৌশল অবলম্বন করেন বিসমিল্লা। অনুরূপ ভাবে উত্তরভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূল ধারায় সন্তুরকে এনে ফেলেন শিবকুমার। না, যন্ত্রটি নতুন নয়। তবে, যে ভাবে ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হতে থাকল, তা নতুন।
একই সঙ্গে বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতে অনায়াস বিচরণ ছিল শিবকুমারের। কখনও প্রখ্যাত বাঁশিবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে জুটি বেঁধে, তো কখনও তার সঙ্গে ব্রিজভূষণ কাবরার গিটার জুড়ে তৈরি হয় ভারতীয় সঙ্গীতের ‘ত্রয়ী’ যাঁরা ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে ফিউশনেও অনায়াস বিচরণ করেছেন, নিরীক্ষা করেছেন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শব্দপট খানিক বদলে দিয়ে আরও বেশি আধুনিক করেছেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যা ছিল এক ধরনের ‘আধুনিকতা’ বা ‘মডার্নিটি’। সে দিক থেকে দেখতে গেলে রবিশঙ্কর-আলি আকবরের সার্থক উত্তরসূরি এই ত্রয়ী।
আশির দশকের শেষ এবং নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে দুই বন্ধু হরিপ্রসাদ ও শিবকুমারের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। ফাইল চিত্র
মনে পড়ে একটি অ্যালবামের প্রচ্ছদ। জলরঙে আঁকা এক খণ্ড পাহাড়ভূমি৷ দূরে শ্বেতশুভ্র পর্বতমালা৷ নীচে ঝাউ গাছের সারি৷ চড়াই-উতরাইয়ে সবুজ ঘাসের গালিচা উপত্যকা বেয়ে নীচে নেমে গিয়েছে একচিলতে লেকের গায়ে৷ তিরতিরে জলে পাহাড়-গাছের ছায়া৷ অনিন্দ্য প্রেক্ষাপট আরও বাঙ্ময় এক পাল মেষের উপস্থিতিতে৷ তাদের মালিক দু’জন একটু তফাতে দাঁড়িয়ে৷ একে অপরের দিকে চেয়ে৷ স্বামী-স্ত্রী? প্রেমিক-প্রেমিকা? উত্তর দেয় না এই ছবি৷ আপনা থেকেই মনমাঝে জন্ম নেয় সুরমূর্ছনা, সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই কেবল কাজে…। বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে অপার নিসর্গ। শান্ত হয় মন, বার বার ফিরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ভূস্বর্গের সেই অচিনপুরে৷ ১৯৬৭ সালে ভারতীয় সঙ্গীতের ত্রয়ী শিবকুমার, হরিপ্রসাদ এবং ব্রিজভূষণ কাবরার এলপি রেকর্ড ‘কল অব দ্য ভ্যালি’, তার এমন অসামান্য প্রচ্ছদ এবং সুরমূর্ছনা মিলিয়ে তৈরি করেছিল এক অনবদ্য প্যাকেজ! প্রকাশের পরেই এই ‘কনসেপ্ট অ্যালবাম’ ছুঁয়ে ফেলেছিল জনপ্রিয়তার শিখর৷ শিবকুমার এবং হরিপ্রসাদের যন্ত্রের সঙ্গে আমজনতার কাছে পরিচিত হয় আরও একটি যন্ত্র— ব্রিজভূষণের গিটার। ‘আলাপ’, ‘বিলম্বিত’, ‘দ্রুত’, ‘ঝালা’র চেনা ছক ভেঙে যে ভাবে আহির ভৈরব, নট ভৈরব, পিলু কিংবা ভুপ, দেশ বা পাহাড়ি আধারিত সুরমূর্ছনা এক আবেশ তৈরি করেছিল, তা পছন্দ হয়েছিল শ্রোতাদের।
অন্য দিকে, বলিউডে সুরকার জুটি ‘শিব-হরি’ও জনপ্রিয় হয়েছিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এমন দুই ব্যক্তি যে ‘ইয়ে কাঁহা আ গ্যয়ে হাম্’-এর মতো গানে সুর করতে পারেন, তা হয়তো অনেকেরই ধারণা ছিল না। অতঃপর তৈরি হতে থাকল ‘ফাসলে’, ‘চাঁদনি’, ‘পরম্পরা’-র মতো ছবির সুর। পাশাপাশি মঞ্চে যুগলবন্দি। মুম্বইয়ের ফিল্মি দুনিয়ায় কাজ করতে আসার আগে শেষ করেছিলেন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা।
আশির দশকের শেষ এবং নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে দুই বন্ধুর সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। এক সময়ের সফল জুটিকে দীর্ঘদিন মঞ্চে দেখা যায়নি। ১৯৯৫ সালে দীর্ঘ ব্যবধানে এক সঙ্গে দিল্লির নেহরু সেন্টারে বাজান শিব-হরি। তবলায় ছিলেন অধুনা প্রয়াত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর আবার দু’জন এক সঙ্গে দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠান করতে থাকেন। একাধিক বার এসেছেন কলকাতাতেও। কলকাতা শিবকুমারের বরাবরই অন্যতম প্রিয় শহর ছিল। ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স ছাড়াও প্রায় প্রতি মরসুমে একবার আসতেন।
চারিত্রিক ভাবে দৃঢ় শিবকুমারের একটি গল্প না-বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যে সময়ের কথা, তখন শিবকুমারের বয়স ২১। জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বক্শি গুলাম মহম্মদের জন্য একটি অনুষ্ঠানে বাজাতে বলা হয় শিবকুমারকে। সানন্দে রাজি হন তিনি। কিন্তু যেখানে অনুষ্ঠান হওয়ার কথা, সেই জায়গায় গুলাম আসেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে যান। কারণ, তিনি মনে করেছিলেন সংগঠকরা তাঁর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখাননি। তাঁর সামনে উঁচু মঞ্চে বসে কারও অনুষ্ঠানে আপত্তি ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। ফলে সংগঠকরা শিবকুমারকে বলেন, মাটিতে বসে বাজাতে। তিনি রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘‘মাটিতে যন্ত্র রাখব না!’’ পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছিল, শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান জানাচ্ছেন না ওঁরা। আমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন বাবা।’’
হিমালয়ের কোলে জন্ম বলেই হয়তো তাঁর সুরে লেগে থাকত পাহাড়িয়া রাগের রেশ। ফাইল চিত্র
হিমালয়ের কোলে জন্ম বলেই হয়তো তাঁর সুরে লেগে থাকত পাহাড়িয়া রাগের রেশ। স্বরবিন্যাস ছিল শান্ত অথচ রোম্যান্টিক। উপত্যকায় বেড়ে ওঠা বলেই হয়তো তিনি বাজনায় এক লহমায় তুলে আনতে পারতেন পাহাড়-নদী-মেঘগর্জন-ঝর্নার শব্দ। নিসর্গের দেশ ছেড়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন ‘চিরশান্তির’ দেশে। তাঁর দেখানো পথেই অবশ্য সন্তুরের মূর্ছনা শোনা যাবে। যেখানে প্রকৃত শিল্পীর সাধনার সার্থকতা।