সন্তানকে বড় করার যাবতীয় দায়িত্ব এবং ইচ্ছে আমার ভিতরে আমি লালন করেছি।
আমি বাবা হতে চাই। সন্তানকে বড় করার যাবতীয় দায়িত্ব এবং ইচ্ছে আমার ভিতরে আমি লালন করেছি। আমার বিয়ে হয়নি বা বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। বিচ্ছেদ এতটাই তিক্ত যে আবার নতুন করে অন্য কোনও সম্পর্কে যাওয়ার কথা আমি ভাবতেই পারি না।
তবুও আমি বাবা হতে চাই।
আমি আমার চারপাশে এমন কয়েক জন বাবাকে দেখতে পাই। আসলে বিবাহবিচ্ছেদ মানে পরিবার থেকে ছিন্ন হওয়া নয়। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের মধ্যে বিয়ের ইচ্ছে নেই। কিন্তু পরিবারের স্বপ্ন আছে। মা অথবা বাবা হওয়ার বড় আকাশ আছে। তারা অনায়াসে বলতে পারে, ‘আমি একক মা, আমি একক বাবা’। একক বাবার সন্তানের মায়ের প্রয়োজন নেই। ঠিক তেমন করেই একক মায়ের সন্তানের বাবার প্রয়োজন নেই।
তবে এমন বাবা কিংবা মা হওয়া কিন্তু সহজ নয়। উইন্ডোজের আগামী ছবি ‘বাবা বেবি ও...’ কিন্তু এমনই এক ‘সত্যি’ বাবার কথা বলে। প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান আনার খবরে ভারত তথা বিশ্ব যখন চর্চায় মগ্ন, তখন মনে হল আমার দেখা সেই সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান নেওয়া একক বাবার কথা বলি। ‘বাবা বেবি ও...’ আর একক বাবার কথা লিখি।
দেখেছি একক বাবা হওয়া সোজা নয়। এ ক্ষেত্রে সন্তান বাবার সঙ্গে মাকেও পেতে চাইবে। সমাজের প্রেক্ষিতেও বিষয়টা খুব সহজ নয়। একক বাবা বা মা হতে চাইলে সবচেয়ে আগে যে প্রশ্নটা সমাজ আমাদের করতে শেখায়, তা হল সারোগেসি-ই কেন? তা হলে কি সেই একক বাবা অথবা মা সন্তান ধারণে অক্ষম? অনেক সময় দম্পতিরাও সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান গ্রহণ করেন, যেমন করেছেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া বা প্রীতি জিন্টা। সে ক্ষেত্রে লোকে খোঁজে বাবা নাকি মা, সন্তানের জন্ম দিতে কে আসলে অক্ষম?
উইন্ডোজের আগামী ছবি ‘বাবা বেবি ও...’র প্রেক্ষাপট ধরে যদি এগোই, তা হলে দেখতে পাই— সেখানে যে একক বাবার কথা বলা হচ্ছে, সে যখন সারোগেসির সিদ্ধান্ত নেয়, তখন প্রাথমিক ভাবে সমাজ এবং পরিবারের মধ্যে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। আমিও খানিক ভয় পেয়েছিলাম। সন্তান আসার পরে সেই পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই পরিবারের অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ছেলের বাবা-মা যেন নতুন করে জীবনের আলো দেখতে পেয়েছেন। এখন সে বাড়িতে গেলে দেখি বাড়িভর্তি হুল্লোড়। সকলে ছুটছে দুই ফুটফুটে প্রাণের নেশায়। এই তো কিছু দিন আগেই ওদের অন্নপ্রাশন খেয়ে এলাম। খেয়াল করে দেখলাম, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব— সকলেই এই সারোগেসির সিদ্ধান্তকে সানন্দে মেনে নিয়েছেন। কেউ ব্যঙ্গ বা তির্যক মন্তব্য করেননি। সমাজও মেনে নেয়, যদি আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সারোগেসির এই অধ্যায়কে উদযাপন করি। হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতে পারে সারোগেসির মাধ্যমে পাওয়া এই সন্তানের মা আসলে কে? যার মাধ্যমে সন্তান জন্ম নিল, সেই মায়ের নাম কী? আমরা জানব না এই বিষয়টা? এই প্রশ্ন হয়তো বহু বাবা-মাকেই শুনতে হয়েছে। প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার ক্ষেত্রেও দেখলাম কেউ কেউ প্রশ্ন রাখছেন, যে মা নিক-প্রিয়াঙ্কার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করলেন, তাঁকে কেন সামনে আনবেন না অভিনেত্রী?
উইন্ডোজের আগামী ছবি ‘বাবা বেবি ও...’ কিন্তু এক ‘সত্যি’ বাবার কথা বলে।
আমি দেখেছি পেশাগত কারণে অনেক সারোগেট মা নিজেকে সামনে আনতে চান না। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তাঁর গোপনীয়তাকে সম্মান করা উচিত। এখনও আমাদের সমাজে সেই মা যিনি অন্যজনের জন্য সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন, তাঁকে সহজ করে দেখার অভ্যাস তৈরি হয়নি। তাই তাঁর ইচ্ছে এবং যিনি সন্তান নিলেন, তাঁর সমর্থনে সারোগেট মা নাই বা সামনে এলেন। কী এসে যায়?
প্রশ্ন আরও আছে। সন্তান বড় হয়ে মায়ের কথা জানতে চাইবে না? এ ক্ষেত্রেও আমি একটু গভীরে বিষয়কে নিয়ে যেতে চাই। পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া এই ভয়ঙ্কর করোনা রোগ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। এই শেখার মাধ্যমে দেখেছি, বাবা অথবা মা হারানো অনেক সন্তান তাঁদের ছাড়াই বড় হয়ে উঠছে। উঠতে পারে। অনেকেই আজ পিতৃ কিংবা মাতৃহারা। তাই বলে কি তারা মানুষ হচ্ছে না? কারও হয়তো দিদা বা ঠাকুমা আছে, কারও দাদু। হয়তো পরিবারের অন্য কেউ আছে। এ ভাবেও হয়। কোনও মাকে তাঁর সন্তানের বাবার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। কোনও বাবাকে তাঁর সন্তানের মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। পরিবার নির্মাণের ক্ষেত্রে বলে দেওয়া হচ্ছে, এক জন মাকে বাবা খুঁজে নিতে হবে। আর এক জন বাবাকে মা খুঁজতে হবে। সারোগেসি এই বাধ্যতা থেকে আমাদের মুক্ত করছে। সারোগেসি দেখিয়েছে বিচ্ছেদ যেমন একটা বিচ্ছিন্ন সমাজের ছবি তৈরি করে দেয়, সারোগেসি ঠিক তার বিপরীতে এসে সেই বিচ্ছিন্নতাকে পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করে। এখানেই সারোগেসির পূর্ণতা।