গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অনেকটা সময় চলে গেল... কিন্তু নদীর মতো ওই চোখ দুটো আমাকে বারবার থামিয়ে দিচ্ছে। ওখান থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসা যায় না। আর ওই সদাহাস্য ঝর্নার মতো আবেগ, প্রেমকে যা কিছুতেই সরে যেতে দেয় না। যার তরঙ্গে তরঙ্গে সিনেমা— তাকেই বা ভুলতে পারলাম কই? এই দুই বিপরীত মানুষ এক হয়ে আমার সামনে আজ। প্রথম জনের নাম ঋষি কপূর। দ্বিতীয় জন ইরফান খান।
ইরফানের চোখ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারে। সব বলা আছে ওই দুটো চোখে। এই চোখ নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ আমার পুরনো কথা মনে পড়ছে...মানিকদা ‘অপুর সংসার’-এ ‘অপর্ণা’-র জন্য আমায় যখন ভাবছেন তখন মঙ্কুদি, মানে বিজয়া রায় বলেছিলেন,‘‘ওর তো কোঁকড়ানো চুল, ওকে অপর্ণা মানাবে?’’তাতে শুনেছি মানিকদা বলেছিলেন, ‘‘ওর চোখ দুটো দেখেছ?’’ মানিকদা অভিনেতার চোখের উপর জোর দিতেন। অন্য বিষয় নিশ্চয়ই ভাবতেন, কিন্তু আগে চোখ। আমার চোখ নিয়েও পরে দেখেছি মানুষ কতরকম ব্যাখ্যা করেছেন।
ইরফানের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় ওর ওই চোখ দুটো ওর অভিনয়ের যে ‘ইউনিকনেস’সেটা বার বার মনে করিয়ে দেয়। ওই চোখ ছাড়িয়ে অন্য কোথাও যাওয়া যায় না। এই যে মানিকদার জন্মের একশো বছর, চারদিকে হইহই। আচ্ছা, সময় যদি মানিকদা আর ইরফানকে এক জায়গায় নিয়ে আসত? আমি নিশ্চিত মানিকদা ওঁকে নিয়ে ছবি করতেন। কিন্তু কী ছবি করাতেন? ‘জন অরণ্য’? ‘মহানগর’? না, অনিলবাবুর চরিত্রটা যে ভাবে সকলের মনে গেঁথে আছে! তা হলে?
‘অভিযান’। হ্যাঁ, ‘অভিযান’-এর নরসিংহ। এর চেয়ে ভাল আর কিছু যেন হত না।
‘অভিযান’- ছবির একটি দৃশ্য
আর ঋষি কপূর? ওর জন্ম এমন এক পারিবারিক ভাবধারা এবং ঐতিহ্যের মধ্যে যেখানে রক্তেই সিনেমা। ইরফান শিক্ষিত অভিনেতা। আর ঋষি আমাদের মতো ঠেকে শেখা অভিনেতা। এমনিতেই ভারতীয় সিনেমার আকাশে কপূরদেরঅবদান আজ ইতিহাস। সত্তর দশকের হিন্দি সিনেমার প্রথাগত নায়কের স্টাইল স্টেটমেন্টকে আরও রঙিন করে দিয়ে ঋষি জায়গা করে নিল অগুণতি মহিলা ভক্তের হৃদয়ে। ওর ছবির ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকল এমন কিছু গান যা এখনও অমলিন। ভালবাসা, বিরহ, বিচ্ছেদ, না বলতে পারা প্রেম! সব ক্ষেত্রেই ঋষির অবস্থান! তাকে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য!
নিজের অভিনয় জীবনের শুরুর দিকটা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আত্মজীবনীতে নিজেকে অভিনেতা বলতে কুন্ঠা বোধ করেছিল ঋষি। এটা নিছকই তার শিল্পীসত্তার বিনয়। সিনেমার সঙ্গে জড়িত মানুষেরাই একমাত্র জানেন, বোঝেন, গাছের ডাল ধরে নাচ গান করার বিষয়টা নেহাতই সহজ নয়। ওর সিনেমা প্রেমিক পুরুষের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল, ফলে অচিরেই ঋষি রোম্যান্সের আইকন। ওর শুরুর দিকের ‘জাহরিলা ইনসান’ছবিটি কন্নড় আর্থহাউস ক্লাসিক ‘নাগারাহাভু’র হিন্দি ভার্সান। এই ছবিটিতে ওর অভিনয় দক্ষতার যে প্রমাণ আমরা পাই তাতে করে মনে হয় ওকে প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করতে পারেননি সেই যুগের পরিচালকেরা।
আরও পড়ুন- 'এক ডিনার ডেটে ঋষি বলল বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবছ?'
আশ্চর্য লাগছে আমার। চরম বৈপরীত্য এই দুই অভিনেতার উত্থান সাফল্য, জনপ্রিয়তায়। আকাশের দু’টি উজ্জ্বল নক্ষত্র! মৃত্যুতে কোথায় যেন মিলে গেল!
দীর্ঘ অবসরের পর ঋষির সিনেমায় ফেরা এবং অন্যদিকে শরীরে বাসা বাঁধা মারণরোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইরফান খানের ওই একই ছবিতে আবার অভিনয়ে ফিরে আসাএকটা কাকতালীয় বিষয় হয়তো। কিন্তু যেটা চিরকাল সত্যি হয়ে থাকবে সেটা হল এই ছবিতে দু’জনের পাল্লা দিয়ে অনবদ্য অভিনয়।
ইরফানের চলে যাওয়ার কিছু দিন আগে ওঁর মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। ইরফান ওই সময়ে মায়ের কাছে থাকতে পারেননি। আবার কৃষ্ণাজি যে দিন চলে গেলেন সে দিনও ঋষি ওঁর কাছে ছিল না! তাঁর দু’দিন আগেই রণবীরের সঙ্গে ও ট্রিটমেন্টের জন্য বাইরে চলে যায়। এর মধ্যেই কি কোনও সূত্র আছে? এই অজানা প্রশ্ন নিয়েই তো সারাজীবন ফিরছি আমরা!
২০০১ সালের একটা ঘটনা। লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। আসিফ কাপাডিয়ার ‘দ্য ওয়ারিয়র’ ছবির প্রিমিয়ারের স্ক্রিনিং। সেখানেই প্রথম দেখি ইরফানের অভিনয়। না, তখন নামও জানতাম না। শুধু যেটা মনে আছে, আমায় মুগ্ধ করেছিল ওর চোখ। অসাধারণ!
ইরফান বলেছিল, “আমি অভিনেতা হতে চাই যাতে দর্শক আমার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পান’’
আমাদের আবার দেখা হল ভেনিসে। আমি গিয়েছিলাম ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র সিক্যুয়েল গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’র জন্য। আর ইরফান ছিল বিশাল ভরদ্বাজের ‘মকবুল’ছবিটির জন্য। আবারও সেই বিস্ফোরণ। সেই অনবদ্য চোখের অভিনয়। যে চোখ চিনিয়ে দেয় নীরবতার মধ্যেও কত ভাষা। কত অনুভূতির প্রকাশ। মনে পড়ে যাচ্ছিল বেশ কিছু বছর আগের কথা। সেই নাম না জানা অভিনেতাই আজকের ইরফান।
ও যে কত ভাল বাংলা বলতে পারে সেটা জানলাম অনেক পরে। আমায় ডাকা হয়েছিল ‘নেমসেক’ছবিটিতে ওর অভিনয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতে। মানুষটা কিন্তু স্বল্পভাষী। তবুও তার মধ্যেই অদ্ভুত একটা ম্যাজিক আছে। শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সেটা সিনেমাতেও। ওর অবস্থান আপনাকে ভাবাবেই। কি একটা যেন রেশ রেখে যাবে...পিছন ফিরে তাকাতেই হবে...।
এই দু’জন অভিনেতার অভিনয়শৈলী, উপস্থাপনা, ম্যানারিজম কোনও দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এক নয়, তবুও যেন কিছু একটা এক।
ঋষি তার সিনেমার চরিত্রদের লালন করেছে অসম্ভব উচ্ছ্বল এবং প্রাণবন্ত অভিনয়ের প্রকাশভঙ্গিমায়। সেই আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। ‘হাম তুম’ছবির সেই ‘ম্যায় শায়র তো নেহি...’গানটিতে ওর উপস্থিতি, হাসি আপনাকে অনিবার্য সমর্পণের দিকে ঠেলে দেবেই। গোটা স্ক্রিন জুড়েই যেন তখন ওর আধিপত্য।
ওর অভিনয়ের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল ‘ওয়ান হান্ড্রেড টু নট আউট’ছবিটির কথা। ওখানে অমিতাভ বচ্চনকে খাইয়ে দেওয়ার একটি দৃশ্য প্রমাণ করে দেয় নিজের দিনে ও যে কোনও বড় অভিনেতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অভিনয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘মুল্ক’ ছবিটি ওর অন্যতম সেরা ছবি। যেখানে একজন রিটায়ার্ড ইসলাম-বিদ্বেষী মুসলিম ল’ইয়ারের চরিত্রের সূক্ষ্ম এবং পরিমিত সাবলীল অভিনয়ের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গিয়েছে সে। “আজ জো হাম ফয়সলা কর রহে হ্যায়, উওহ হামারে কাল কা ফয়সলা করেগা।” অন্য অনেকেই হয়তো এরকম সংলাপ দর্শকের হাততালি কুড়নোর জন্য বলবে। কিন্তু ঋষি বরাবরই সেই ভারসাম্য রক্ষা করেছে। ওভারঅ্যাক্টিংয়ের প্ররোচনায় পা না দিয়ে ঋষি চ্যালেঞ্জিং চরিত্রগুলিকে নিজের অভিনয়শৈলীর গুণে করে তুলেছে বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবসম্মত।
ঋষি তার সিনেমার চরিত্রদের লালন করেছে অসম্ভব উচ্ছ্বল এবং প্রাণবন্ত অভিনয়ের প্রকাশভঙ্গিমায়
অভিনেতা হিসেবে ঋষি কখনও নিরাপত্তাবোধের অভাব অনুভব করেনি। সিনেমার দৃশ্য শুধু যে তার একার মুন্সিয়ানা দেখানোর জায়গা নয়, সেখানে সহ-অভিনেতাকেও তার প্রয়োজনীয় স্পেসটুকু দিতে হবে, এটা কেউ কাউকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা নয়,এগুলো ঋষি বুঝত।স্টারডম নয়, ওর কাছে সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে সিনেমার প্রতি সততা। ‘লাক বাই চান্স’, ‘লাভ আজকাল’, ‘দো দুনি চার’, ‘কাপুর অ্যান্ড সন্স’ ইত্যাদিএরকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে।
অন্যদিকে, ইরফান আন্ডার অ্যাক্টিং-এ অন্যতম সেরা। ওর সাদামাটা ভাবলেশহীন অ্যাটিটিউড, না-অভিনয়, অনায়াস সংলাপ বলার ধরন ঋষির অভিনয়প্রথার সঙ্গে একটা স্পষ্ট বৈপরীত্য। সূক্ষ্ম ছোট ছোট অনুভূতিগুলোকে অনায়াস ভঙ্গিতে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইরফানের দক্ষতা আকাশছোঁয়া। ভুরু, হাসি, চোখ, মুখের মাসল্ তার অভিনয়ের সাম্রাজ্যকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। ও বলেইছিল,‘‘দর্শকদের সঙ্গে স্টারের বড্ড দূরত্ব। স্টারেদের সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড আছে। তারা সব পারে। আমি অভিনেতা হতে চাই যাতে দর্শক আমার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পান।’’
ইরফানের রহস্যঘেরা অভিব্যক্তির দক্ষতা, যোগ্যতা ক্রমশ তার প্রতি প্রত্যাশা বাড়িয়ে তুলছিল। বারবার দেখেও যেন সাধ মেটে না ওর অভিনয়। যেন মনে হয় মানুষটা খুব চেনা।
এক অদ্ভুত দোদুল্যমানতা। যতটা সে প্রকাশ করে তার অনেকটা যেন অপ্রকাশিত রেখে যায়। হাবেভাবে কথায় কেমন যেন একটা ভাসিয়ে দেওয়া। যেন মনে হয় ছুঁয়েও ছোঁওয়া হল না। অদ্ভুত বহুমাত্রিক মেলবন্ধন। এক অনবদ্য ডাইমেনশন।
একজন এল রুপোলি পর্দার বৈভব নিয়ে। অন্য আর একজন যেন ঠিক পাশের বাড়ির মানুষটার মতোই নির্লিপ্ত
পারিবারিক কোনও ঐতিহ্য বা যোগসূত্র নেই সিনেমার জগতের সঙ্গে। একজন আউটসাইডার হয়েই তার আসা।
একজন এল রুপোলি পর্দার বৈভব নিয়ে। অন্য আর একজন যেন ঠিক পাশের বাড়ির মানুষটার মতোই নির্লিপ্ত।
ঋষি বরাবরই খবরের শিরোনামে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এনগেজমেন্ট, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, মতামত ভয়ডরহীনভাবে প্রকাশ। কথা বলার সুযোগ, পরিচিতি, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করার স্বাধীনতাবোধ।
অন্যদিকে ইরফান জীবনে নানা জটিল ও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে করতে একটা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
দু’জনেই আমার অত্যন্ত স্নেহের, ভালবাসার মানুষ। অভিনেতা, স্টার। দু’জনেই খ্যাতির শীর্ষ ছুঁয়েছে। সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা দুটো মানুষ, ব্যক্তিগত পরিবার-পরিজন ভালবাসা ও কাছের মানুষের উর্ধ্বে তাদের দু’জনেরই একটা বিরাট বড় পরিবার রয়েছে, যারা ওদের জন্য কাঁদে হাসে লড়াই করে প্রাণভরে ভালবাসে।
এই বিপর্যস্ত এবং টালমাটাল সময়ে ওদের দু’জনের চলে যাওয়ার খবর আকস্মিক শুধু নয়, অবিশ্বাস্যও বটে। এমনই একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি এই মুহূর্তে যে ওদের ঠিক করে বিদায় জানানোর সুযোগ থেকেও বঞ্চিত আমরা। ঋষি আর ইরফানের এই মৃত্যু কোন ভাষায় লিখব জানা নেই।
এই শূন্যতা পূর্ণ হবে না। আমরা কি সত্যিই এই গভীর শোক, এই শূন্যতাকে কোনওদিনও ভুলতে চাই? পূর্ণ করতে চাই?
আমি বিদ্ধস্ত!