Samragnee Bandyopadhyay

ছবির পোস্টারে নায়ক-নায়িকা-পরিচালকের পাশাপাশি লেখকেরও নাম থাকলে ভাল লাগবে: সম্রাজ্ঞী

নেই নাটকীয়তার ছোঁয়া! ‘বৌদি ক্যান্টিন’-এর নায়ক-নায়িকার সংলাপ মন ছুঁয়ে যায় দর্শকের। বাংলা ছবির চরিত্ররাও তা হলে এমন সহজ ভাষায় কথা বলতে পারে? দেখিয়ে দিলেন সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

পৃথা বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২২ ১৮:০৩
Share:

স্বাধীনচেতা বলে ‘সুনাম’ রয়েছে সম্রাজ্ঞীর।

এক দশক ধরে কবিতা লেখা। স্বীকৃতি, পরিচিতি সব কবিতা থেকেই। পাশাপাশি চলছিল পড়ানো এবং পিএইচ ডি। হঠাৎই সুযোগ আসে ‘মুখার্জীদার বউ’-এর চিত্রনাট্য লেখার। আর জীবন বেশ খানিকটা বদলে যায়। ধীরে ধীরে যখন তিনি বুঝতে পারেন, মানুষ তাঁর লেখা গল্প পর্দায় দেখতে পছন্দ করছেন, তখন থেকেই গল্পকার হিসাবে নিজের জায়গা তৈরি করার চেষ্টাটা পাকাপাকি ভাবে শুরু করেন। ভাগ্যিস করেছিলেন! তাই ‘বৌদি ক্যান্টিন’-এর মতো ছবিতে দর্শক এমন সহজ-সরল অথচ স্পষ্ট সংলাপ উপহার পেলেন। না আছে অতিনাটকীয়তা, না আছে আঁতলামির চটক। ঝরঝরে সংলাপেও যে দর্শকের মন ছোঁয়া যায়, তা প্রমাণ করে দিলেন সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

স্বাধীনচেতা বলে ‘সুনাম’ রয়েছে সম্রাজ্ঞীর। কখনও কোনও পত্রপত্রিকা যদি বিশেষ কোনও আঙ্গিকে পদ্য বা গদ্য লেখার নির্দেশ দিত, সটান ‘না’ করে দিতেন তিনি। সেই জোর নিয়ে টালিগঞ্জে কাজ করা কি সম্ভব? লেখকের উত্তর, ‘‘টেলিভিশন, ওয়েব সিরিজ, সিনেমা সবেরই নিজস্ব ব্যাকরণ থাকে। অবশ্যই আমি যা যা চাই, সব লিখতে পারি না। কিন্তু আবার সব কিছুই লেখার একটা ধরন রয়েছে। ব্যাকরণ মেনেই সেটা করা যায়। আপাতত যে হেতু আমি ব্যাকরণটা শিখছি, তাই বেশ মজাই লাগছে।’’ পত্রপত্রিকার মতো মতবিরোধের জন্য কখনও কোনও ছবির কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে? সম্রাজ্ঞীর উত্তর, ‘‘এখনও পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছি, তেমন হয়নি। শুরুতে হয়তো রাজি হইনি, তার পর সম্পর্কের খাতিরে শেষ পর্যন্ত করেছি। তবে ইন্ডাস্ট্রিতে কান পাতলেই জানা যাবে যে, সব বিষয়ে আমার একটা নির্দিষ্ট মত আছে। আমি কোনও প্রজেক্ট করলে সেখানে নেহাত যান্ত্রিক ভাবে লিখে যেতে পারব না। সব বিষয়ে আলোচনা থাকবে, মতামত থাকবে। সেগুলো গ্রহণ করতে অনেক সময়ে অন্যদের অসুবিধা হয়। অনেক বারই ঝামেলা হয়েছে, কিন্তু তাই জন্য কাজটাই করিনি, তেমনটা এখনও হয়নি।’’

সম্রাজ্ঞী মনে করেন, যা কিছু স্পষ্ট তারই দু’টো দিক থাকে। তাঁর পড়াশোনার মতোই তিনি চেষ্টা করেন, তাঁর লেখায় সাম্য বজায় রাখতে।

সিনেমা-টেলিভিশন-ওয়েব— সব ক্ষেত্রেই বাংলায় যেন একপাক্ষিক চিত্রনাট্যের রমরমা। ভাল-খারাপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য নির্মাতারা বেছে নেন চড়াদাগের সংলাপ। প্রশ্ন উঠলে বলা হয়, ‘স্পষ্ট ভাবে না বললে দর্শক বুঝতে পারবেন না’। বাস্তবে কি দর্শক সত্যিই এত অবুঝ? সূক্ষ্ম মার্জিত সংলাপ কি তাঁরা ধরতে পারেন না? সম্রাজ্ঞী অবশ্য মনে করেন, যা কিছু স্পষ্ট তারই দু’টো দিক থাকে। মানবীবিদ্যার ছাত্রী হিসাবে চেষ্টা করেন তাঁর লেখায় সাম্য বজায় রাখতে। তিনি বললেন, ‘‘সব ছবিরই নির্দিষ্ট কোনও চাহিদা থাকে। যদি কোনও ছবির চাহিদাই হয় যে, কোনও এক পক্ষকে জিতিয়ে দেওয়া, তা হলে আমায় লেখায় তো সেটা করতেই হবে। কিন্তু আমি মনে করি, সব খলচরিত্রের মধ্যেও একটা আলো থাকে। চেষ্টা করি লেখায় অন্ধকারের মধ্যেও সেই আলোটা যেন একটু বেশি করে দেখা যায়।’’

Advertisement

ঝরঝরে সংলাপেও যে দর্শকের মন ছোঁয়া যায়, তা প্রমাণ করে দিলেন সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়।

কবিতা লেখাই সম্রাজ্ঞীর প্রথম প্রেম। ২০১৬ সালে ‘কৃত্তিবাস পুরস্কার’ এবং ২০১৮ সালে ‘সাহিত্য অকাদেমি’ যুব পুরস্কারও পেয়েছিলেন সেই কবিতারই জন্য। গদ্য লিখতেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। কিন্তু পর্দার জন্য লেখার বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সম্রাজ্ঞীর কাছে কোনটা সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়? তাঁর কথায়, ‘‘আমার কোনও প্রশিক্ষণ নেই স্ক্রিন রাইটিংয়ে। যা কিছু লেখায় ভাল, তা তো পর্দায় ভাল না-ও লাগতে পারে। তাই লেখার সময়ে সব সময়ে একটা ছবি বা ভিস্যুয়াল মাথায় রেখে লিখতে হয়। তবে আরও একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। যদি লেখক আর পরিচালক আলাদা মানুষ হন, তা হলে দু’জনের ভাবনা একসঙ্গে আসা, দু’জনের টিউনিংটা খুব জরুরি। সেটা না হলে কিন্তু বোঝা যায় যে, দু’জনের মননটা এক হয়নি। আমি কাজ করার সময় চেষ্টা করি পরিচালকের মননটা বোঝার। তাঁর সৃজনশীল চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে লেখার চেষ্টা করি। কারণ, দিনের শেষে আমি তো একজন সাপ্লায়ার। যে যেমন ভাবে একটা গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করবে, আমি সেই ভাবনার সঙ্গেই নিজস্ব মতাদর্শ এবং রাজনীতি মিশিয়ে লিখি।’’

‘বৌদি ক্যান্টিন’-এর মতো ছবিতে দর্শক এমন সহজ-সরল অথচ স্পষ্ট সংলাপ উপহার পেলেন।

এই ‘টিউনিং’টা কার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ভাল হয়েছে এখনও পর্যন্ত? ‘‘এটা বলা একটু মুশকিল। আমি ঘটনাচক্রে উইন্ডো়জ-এর সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি। প্রথম ছবির (মুখার্জীদার বউ) পরিচালক ছিল পৃথা (চক্রবর্তী)। যখন একসঙ্গে কাজ করেছি খুব ভাল টিউনিং ছিল। ছবি মুক্তির পরও হয়তো সব সময় সেই টিউনিংটা আর থাকেনি। হইচই-এর ‘উত্তরণ’ আগে আমি লিখেছিলাম। তার পর জয়দীপদা (মুখোপাধ্যায়) সেটার পরিচালনা করেছিলেন। বলতে হয়, উনি আমার সঙ্গে খুব ভাল টিউনিং করে নিয়েছিলেন। ‘বৌদি ক্যান্টিন’ লেখার সময়ে পরমদার (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে খুব ঝামেলা হয়েছিল শুরুতে। হয়তো দু’জনে দু’জনের সুরটা ধরতে পারছিলাম না। আসলে দু’জনেরই তো খুব স্পষ্ট মতামত রয়েছে। কেউই নিজের জায়গা থেকে সরতে চাইনি। পরে অবশ্য সেই কারণেই দু’জনে আরও ভাল ভাবে মিলেমিশে কাজ করতে পেরেছি। এবং দু’জনেই বুঝেছি যে, দু’জনেই কাজটা আরও ভাল করার জন্যই তর্কটা চালিয়ে যাচ্ছি। আসলে অনেক ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি, লেখকরা খুব সহজে পরিচালকের কথায় রাজি হয়ে যান। কয়েক দিনের মধ্যেই কথামতো চিত্রনাট্য লিখেও ফেলেন। আমি এখনও সে ভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত হইনি, হতে চাই-ও না।’’

ইন্ডাস্ট্রিতে কি আরও লেখকের প্রয়োজন? সম্রাজ্ঞীর মতে, ‘‘লেখক আরও বেশি সংখ্যায় সব সময়ই প্রয়োজন। যাঁরা আসতে চান, তাঁদের স্ক্রিনরাইটিং আরও শিখতে হবে। তবে ইন্ডাস্ট্রিরও লেখকদের আরও সম্মান দেওয়া প্রয়োজন।’’ যোগ্য সম্মান কি তা হলে লেখকরা পান না? গল্পকারের মাপা উত্তর, ‘‘হঠাৎ করে আমি এই কথাটা বললে অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, সম্রাজ্ঞীকে এত ভালবাসি, তা-ও এমন কথা কেন বলছে! আসলে বিষয়টা ঠিক তেমন না। কাউকে দোষারোপ করা আমার লক্ষ্য নয়। বা কেউ ইচ্ছে করে এমনটা করেন, তা-ও নয়। তবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এখনও অনেকটাই নায়ক-নায়িকা-পরিচালকে আটকে। তার বাইরে অন্যদের নাম সে ভাবে উঠে আসে না। আমি আমার ফ্র্যাটার্নিটির কথা বলছি। কিন্তু টেকনিশিয়ানদের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যিই। এক জন পরিচালক যতই ভাল হন, ডিওপি ঠিক করে কাজ না করলে ছবিটা ভাল হওয়া সম্ভব নয়। সিনেমা সব সময়ই এক দল মানুষের একত্রিত অবদান, কালেক্টিভ আর্ট। তাই সমস্ত কলাকুশলীর যোগ্য সম্মান প্রাপ্য। লেখকদের সম্মান দেওয়া হয় না, তা নয়। কিন্তু সম্মানের সাম্য নেই। ছবির পোস্টারে এখনও শুধু পরিচালকের নামই যায়। যদিও উইন্ডোজ় আমায় সেই সম্মানটা দিয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ ছবিতেই তা হয় না। তবে ভাবনাটা যার মস্তিষ্কপ্রসূত, সে যদি নিজের নামটা পোস্টারে দেখে, তা হলে তার ভালই লাগবে। হয়তো পরের কাজ আরও ভাল করে করার উৎসাহ পাবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement