অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়
এই গল্প আমাকে শুনিয়েছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে পাঠালেন। আসলে, অরবিন্দের অগ্রজ ‘বনফুল’ বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় গুরুদেবের স্নেহধন্য ছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ একটু কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন এই কিশোর সম্পর্কে। তখন অনিল চন্দ রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবে কাজ করতেন। তিনি অরবিন্দকে পরামর্শ দেন যে বার্ধক্যে কবির শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়ায় অরবিন্দ যেন একটু জোরে কথা বলেন। প্রণাম করার পরই গুরুদেবের জিজ্ঞাসা, ‘‘তুমি বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?’’ অরবিন্দ স্বর উচ্চগ্রামে তুলে উত্তর দিলেন, ‘‘না, আমি অরবিন্দ।’’ গলার জোর শুনে রবীন্দ্রনাথের সহাস্য মন্তব্য, ‘‘না, তুমি কানাই নও সানাই।’’
তাঁর শতবর্ষের মুহূর্তে অরবিন্দবাবু সম্বন্ধে এই গল্পটি রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এমনকি, তাঁকে আমাদের চলচ্চিত্র বোধের একটি ভিত্তি হিসেবেও বর্ণনা করা যায়। সত্যিই তো, চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমরা কেন স্মরণ করব? তিনি কে আমাদের ছায়াছবির মানচিত্রে? অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় কাদের জন্য ছবি করেছেন? এই প্রশ্নের জবাবে বলতেই হবে তাঁর ছবি সিনেমা-বোদ্ধাদের জন্য নয়। শাস্ত্রের কূটতর্ক তিনি সভয়ে পরিহার করেন। আমাদের ফিল্ম সোসাইটির বুদ্ধিজীবীরা এ জন্যই তাঁর প্রতি উৎসাহিত নন।
সত্যি বলতে কি গত শতকের পাঁচের দশক থেকে যখন আমরা সিনেমা দেখার রুচি পুনর্বিন্যাস করতে শুরু করলাম তখন সেখানে একটা মস্ত ফাঁকি ধরা পড়ে যায় আজ। রুচির নির্মাণ ও রুচির একদেশদর্শিতা মোটেই যুগপৎ অভিপ্রেত নয়। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ আমাদের এতটাই ছায়া রোদ্দুর দিলেন যে আমাদের মনে হল জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের জগৎটাই তুচ্ছ বা অকিঞ্চিৎকর। ভুলে গেলাম অনভিজাত বিনোদন বলেই ছায়াছবির প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। এক জন লেখক উদাসীন থাকতেও পারেন, চলচ্চিত্রকারকে শেষ পর্যন্ত জনতার মুখোমুখি হতে হবেই। আমি এমন দাবি করছি না যে শিল্প উৎকর্ষের দিক দিয়ে তিনি প্রথম সারিতে। কিন্তু সবাক যুগ শুরু হওয়ার পরে বাংলা সিনেমার যা চরিত্রলক্ষণ হয়ে উঠল সেই গল্প বলার ক্ষমতা অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় প্রখর তৎপরতায় আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি স্টুডিও যুগের অবসান দেখেছেন, বি এন সরকার ও প্রমথেশ বড়ুয়ার স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেন না। ফলে তিনি একটি উত্তম কাহিনিকে শ্রুতি ও দৃশ্যের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করাকেই জীবনের মূল পাথেয় ভাবেন। চলচ্চিত্র ভাষা বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান তাঁর কৃতকর্মে তেমন মুদ্রিত নেই।
আরও পড়ুন:নানার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার প্রমাণ নেই, রিপোর্ট পুলিশের
তবে এই মুহূর্তে বাংলা ছবির ‘সালঙ্কার দারিদ্র’ দেখে মনে হয় অরবিন্দবাবুরাও বোধহয় দেবতার আশীর্বাদ ছিলেন। অন্তত তাঁর ষাট ও সত্তর দশকের ছবিতে সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের এক ধরনের আত্মপরিচয় নথিভুক্ত আছে। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবি সেই মনোপরিসরের প্রতিনিধি যখন পর্যন্ত বাঙালি মধ্যবিত্ত স্বপ্নবঞ্চিত হয়ে যায়নি। অর্থাৎ, যে মধ্যবিত্ত দৈন্য ও দুঃখকে জানেন কিন্তু জীবনের অচরিতার্থতা তাঁকে স্পর্শ করে না, যে জীবনকে হঠাৎ ছুটির দুপুরের মতো গান ও হাসিকান্নার মধ্যেও খুঁজে পান অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর জন্যেই বানিয়ে যান একের পর এক ছবি। তাঁর সমকালীন তপন সিংহের মতোই তিনি চমৎকার এক গল্প বলিয়ে।
হয়তো অবিচার হল, অরবিন্দবাবুর শিল্পমূল্যই বা কম কিসে? যেমন কিছুক্ষণ (১৯৪৯)— রেলস্টেশনে কয়েক ঘণ্টার গল্প। কিন্তু এখানে বাস্তবকে সাজানোর একটা কারুকার্য আছে। অনেকটা যেমন দু’বছর পরে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় ছিল।
এক ফেমে উত্তম কুমার, সুব্রতা এবং অরবিন্দ
পাঠক একটু ভেবে দেখবেন, এখানে ছায়াছবির সময়, অর্থাৎ রিল টাইম ও বাস্তব সময় বা রিয়েল টাইমকে এক করে দেওয়ার একটি দুর্জয় বাসনা আছে। এই ধরনের বাস্তববাদ বোঝাতে চায় যে তারা বাস্তবের নিজস্ব ধর্মে হস্তক্ষেপের পক্ষপাতী নয়। মধ্যবিত্ত মানুষের হৃদয়ে জমে থাকা মধুর কি চমৎকার ক্ষরণ হয়েছিল এই সিনেমায়। ছোট গল্পে যে মুহূর্তগুলি জ্বলজ্বল করে তেমন আলো অরবিন্দবাবুর সৌজন্যে মূর্ত হয়েছিল। বাণিজ্যিক সিনেমাও যে সুন্দর- লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সংলাপ যে আদৌ অসম্ভব নয়- কিছুক্ষণ একদা তা প্রমাণ করতে চেয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের সেই স্বর্ণযুগে তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অগ্রগামী ও অগ্রদূত যেমন স্মরণীয়, তেমনই স্বচ্ছ ও সুস্থ বাণিজ্য ধর্মের জন্য অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় অভিনন্দনযোগ্য থেকে যাবেন।
দুটি যুদ্ধের মধ্যবর্তী কালে প্রভাত মুখোপাধ্যায় যে গল্পগুলি লিখেছিলেন অরবিন্দের চলচ্চিত্রের ভাবনা সেই কাহিনির মধ্যবিত্তদের গোত্র অনুসরণ করে। এই মাঝারি মাপের চরিত্রেরা অর্থের বৈভব ও বঞ্চনার হাহাকার ছাড়াই জীবনের নানা সম্পদকে ছুঁতে পারে। গত শতাব্দীর সাহিত্য, বিনোদন, রাজনীতি ও সামাজিক অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে এঁরাই বাংলার মুখ। এঁদের রুচি বাঙালির গতিপথ বানিয়ে দেয়। এই মধ্যবিত্তের ত্রুটি যে এঁরা নিরাপত্তামদির, কোনও ক্ষেত্রে সীমা পার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সে নেবে না। কিন্তু মস্ত কৃতিত্ব যে উনিশ শতকীয় মানবতাবাদের উদ্ভাস ও পতন সত্য হয়ে আছে এই শ্রেণির জীবনযাত্রার দ্বন্দ্বে। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ছবিতে দেশ-বিভাগ উত্তর বর্ণহীন বাঙালি জীবনের বিষাদ নেই কোনও। বরং সেলুলয়েডের ফিতের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে স্মিত হাসির সুরেলা নিমন্ত্রণ। সেখানে গানে কথায় বাঙালি গৃহস্থের নিকনো উঠোনটুকু ‘বর্ণচোরা’ বা ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিগুলি আমাদের প্রাণের আরাম, গরমকালের হাতপাখা। ‘নিশিপদ্ম’ পতিতাপল্লির কথা বলে, কিন্তু তাতে ক্লেদ ও গ্লানি। নিশীথের পদ্ম অরবিন্দের হাতে যতটা রূপে ঝলমল ততটা পাপের ফল নয়। আর ১৯৭০-এ মুক্তি পাওয়া এই ছবির জনপ্রিয়তা এত দূর পৌঁছয় যে দু’বছর বাদেই তা শক্তি সামন্তের সৌজন্যে ‘অমর প্রেম’ হিসেবে, আরবসাগরের উপকূলে বিকশিত হয়। সেখানেও চিত্রনাট্যে সাহায্য করেছিলেন অরবিন্দবাবুই।
উত্তম কুমার এবং মিঠু মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে অরবিন্দ
‘অগ্নীশ্বর’ (১৯৭৫), ‘অজস্র ধন্যবাদ’ (১৯৭৭), ‘মৌচাক’ (১৯৭৫) বা ‘পাকা দেখা’ (১৯৮০) এমন এক মেঘমুক্ত কথকতার আয়োজন করে যে আমরা নাগরিকতার বিষণ্ণ ও মর্ষকামী মলাট সরিয়ে হঠাৎ এক সুরভিত আশাশীল অবকাশের আবহ খুঁজে পাই। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বলা যেতেই পারে অরবিন্দবাবু এক সংখ্যালঘু সেকেলে মানসিকতার প্রবক্তা। স্বাধীনতার পর ফাঁকি, দাদু, যুবকের স্বপ্নভঙ্গ ও যুবতীর দীর্ঘশ্বাস, দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয়— কোনও কিছুই তাঁর চিত্রনাট্যে দাগ কাটে না। তিনি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের প্রকৃত অনুজ। বারে বারেই ফিরে যান এক অলীক শান্তিনিকেতনে। ভেঙে পড়া মানুষের মিছিল, সংশয়, হিংস্রতা অরবিন্দবাবুর নেই। তিনি অস্তিত্বকে প্রশ্ন করেন না, স্থির বিশ্বাসে সিনেমাকে বিনোদনের পরিসর হিসেবেই পেতে চান।
আসলে একদা নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও ও বি এন সরকার মশাই বুঝেছিলেন যে বাঙালি সিনেমা বলতে কথায় ও ছবিতে চলমান চিত্রমালা বোঝে। আমাদের সবাক চিত্র ত্রিশের দশক থেকেই ‘বই’ হয়ে যায়। অরবিন্দবাবু সর্বতোভাবে এই কথকতার ধারাটিকে অনুসরণ করে এসেছেন। নিউ থিয়েটার্স ঘরানার অন্তিম প্রতিনিধি অরবিন্দবাবুকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাই হৃদয়ে একটি আক্ষেপের সুরও বেজে ওঠে। সিনেমার এমন নিটোল গল্প শোনার দিনগুলি কেন যে হারিয়ে গেল!
আরও পড়ুন :মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয় ‘ফেলুদা: ফিফটি ইয়ার্স অব রে’জ ডিটেকটিভ’