'অশনি সংকেত'-এর শুটিংয়ে বিশ্ববন্দিত পরিচালক।
১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড। যার বাসিন্দা বেঁচে থাকলে আগামী বছর তাঁর শতবর্ষ উদযাপন হত। কিন্তু আজ উদযাপনের দিন নয়। ২৮ বছর কেটে গিয়েছে তাঁর চলে যাওয়ার। সত্যজিৎ রায়।
যে রায় বাড়ির সদর দরজা কোনও কালেই তালাবন্ধ ছিল না, সেই রায়বাড়িতে আজ লকডাউন।“এমনিতেই মৃত্যুদিনে যে বাবার জন্য অনেক মানুষ আমাদের বাড়িতে আসতেন, এমনটাও নয়। তবে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন আসতেন। রাতে খাওয়াদাওয়া হত।আজ তো সব বন্ধ!’’ শঙ্কার ছায়া সন্দীপের গলায়।
আজ বাবাকেই যেন খুঁজছেন সন্দীপ তাঁর নানা রচনায়।
“বাবার ঘর পরিষ্কার চলছে বেশ কিছু দিন ধরে। তিন বার বাড়ি বদল হয়েছে আমাদের।এমন কিছু জিনিস পাচ্ছি আমরা যা আগে আমি নিজেই দেখিনি। রোজ সকালে উঠে ভাবি, আজ নতুনকীখুঁজে পাব? তবে সকলের জন্য বলি, অপ্রকাশিত কিছু পাইনি।বাবা ফরমায়েশি লেখা ছাড়া আর কিছু লেখেননি। তবে অনেক পেন্টিং, চিঠিপত্র, ছবির স্টিল পাচ্ছি। দেখি, একশো বছরটা যত ভাল করে করা যায়...”,আনন্দবাজার ডিজিটালকে জানালেন সন্দীপ রায়।
সন্দীপ খুলে ফেললেন ‘অশনি সংকেত’-এর চিত্রনাট্যের খাতা
বাড়ি থেকে কম বেরতে চাওয়া। নিজের জগৎ নিয়ে থাকা সন্দীপকে এই লকডাউন কতটা প্রভাবিত করল?
বাড়িতে কেউ আসছে না, এটা যেমন মেনে নিতে পারছেন না তিনি, তেমনই এই অনিশ্চয় মৃত্যুদিন কবে ফুরোবে? এই প্রশ্ন দিন রাত তাঁর মনেঘুরছে।
এ কোন সময়? ‘অশনি সংকেত’! সন্দীপ খুলে ফেললেন ‘অশনি সংকেত’-এর চিত্রনাট্যের খাতা।
“বাবার মনে হয়েছিল হয়তো, শহর নিয়ে অনেক ছবি হল। এ বার গ্রামে ফিরে যাই। ‘অশনি সংকেত’ কালার হওয়ায় সমালোচকেরা বলেছিলেন, এই বিষয়ের ছবি কেন কালার হল?বাবা বলেছিলেন, ‘বাইরের প্রকৃতি রঙিন। ঝলমলে। মানুষের খিদে সে বুঝছে না।’ আজও তো তাই। বসন্ত, গ্রীষ্ম তরতাজা, অথচ চারিদিকে মৃত্যু মিছিল।”
আরও পড়ুন: খাবারের জন্য মানুষ ছুটছে, এর পরেও খাওয়া নিয়ে বড়াই: অরিন্দম শীল
তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে ‘অশনি সংকেত’-এর একটি দৃশ্য।
দৃশ্যটা ছিল এরকম...
অনঙ্গর বৌ তার স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে গ্রামের সীমার বাইরে থেকে মাঠ পেরিয়ে কারা যেন বোঁচকা-বুঁচকি-হাঁড়ি-কলসি নিয়ে এগিয়েই আসছে— জনাছ’য়েক লোকের একটা গোটা পরিবার। একটু পরে বোঝা যায়, সেই পরিবারটির কর্তা গোবিন্দ চক্রবর্তী। ক্যামেরায় ধরা কম্পোজিশনটা এমন যে, ফ্রেম-এর ডাইনে-বাঁয়ে তিলমাত্র ফাঁকা জায়গা নেই। সবটাই জুড়ে পরিবারের সেই সদস্যরা। এর পরেই শুরু হয় আঙ্কিক নিয়ম মেনে ছন্দোবদ্ধ কাটিং— সেই দলটির সেকশনাল ক্লোজ শট। সেই ক্লোজ শট-এ কারও মাথায় একটা মাটির হাঁড়ি, কারও বগলে একটা ছেঁড়া মাদুর, কেউ হাত দিয়ে ধরে আছে কোনও শিশুর হাত। দুঃস্থ পরিবারের শেষ সম্বলটুকু সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে।
ক্যামেরার ফ্রেম জুড়ে এগিয়ে আসছে সেই পরিবারটির মানুষজন। এ বার ক্যামেরা পিছোতে থাকে। দেখা যায়, শুধু মুষ্টিমেয় সেই ক’টি লোকই নয়, তার দু’পাশে, পিছনে অসংখ্য মানুষ, মানুষ আর মানুষ। দুর্ভিক্ষ ওদের তাড়া করেছে, ঘরছাড়া করেছে। নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে ওরা যাত্রা করেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। শটটা কিছু ক্ষণ আমাদের চোখে সইয়ে এর ওপর ভেসে ওঠে একটি নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত লেখা: সে বার মানুষের তৈরি মন্বন্তরে মোট এত লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটেছিল...
করোনা আবহে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল 'অশনি সংকেত' ছবির পটভূমি
আজকের ছবির সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায় ওই ক্ষুধা মৃত্যুর ছবি! সন্দীপ বলছেন, “বাবা মন্বন্তর দেখেছিলেন। বলতেন, বাড়ির বাইরে বেরোলেই মৃত্যুমিছিল। লাশ পেরিয়ে পেরিয়ে যেতে হত তখন। আর চারদিকে শুধু ‘ফ্যান দাও’ ‘ভাত দাও’ আর্তনাদ!’’ চুপ করে যান সন্দীপ। করোনার মৃত্যুমিছিল, মন্বন্তরের মৃত্যু যন্ত্রণা আর তাঁর বাবার চলে যাওয়া আজকের মৃত্যু উপত্যকায় কোথাও যেন মিশে যাচ্ছে।
বিশ্বের মৃত্যু-ছায়া ছুঁয়ে দিল ২৮ বছর পিছিয়ে যাওয়া সেই দিনকে,যে দিন বিশ্বের মানিক অস্তমিত হয়েছিল মৃত্যুর করাল গ্রাসে।