লোকে গল্প বলতে ভুলে গিয়েছে— সিনেমা তৈরির ব্যাপারে এই কথাটা একবার বলেছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। কী বলছির চেয়েও কখনও কখনও বড় হয়ে দাঁড়ায় কী ভাবে বলছি। এতটাই যে, তা ছবি তৈরির মূল উদ্দেশ্যটাকেই ব্যর্থ করে দেয়। প্রভাসের হিন্দি ডেবিউ ‘সাহো’ দেখতে গিয়ে এই কথাটাই বার বার মনে হচ্ছিল।
‘বাহুবলী..’র পরে আর একটা ভারতীয় ছবি, যা স্পেশ্যাল এফেক্টস, অ্যাকশন, লোকেশন সব দিক দিয়েই চোখ ধাঁধিয়ে দেবে— সাড়ে তিনশো কোটি বাজেটের ‘সাহো’র প্রচার শুরু হয়েছিল এ ভাবেই। ‘বাহুবলী..’তে দর্শক যে ভাবে প্রভাসকে ভালবেসেছিলেন, তখনই তাঁর বলিউডে প্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল। ‘সাহো’ অবশ্য পুরোপুরি বলিউডের ফসল নয়। পাঁচটি ভাষায় মুক্তি পাওয়া এই ছবির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় সুযোগটা পেয়েছিলেন প্রভাস। কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার করার অবকাশ পেলেন কই? প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে নাগাড়ে ধুন্ধুমার অ্যাকশন, চেজ়িং সিকোয়েন্স, ফাঁকে ফাঁকে রোম্যান্স ইত্যাদির মাঝে অভিনেতাদের পাওয়া গেল না। নায়ক-নায়িকা ছাড়াও বাকি চরিত্রগুলোকেও টিপিক্যাল ছকের বাইরে বার করে আনেননি পরিচালক সুজিত। স্টোরিলাইন যেখানে দুর্বল, ন্যারেশনও মন্থর গতির, সেই চিত্রনাট্য নিয়ে যে তিন ঘণ্টা হলে দর্শককে বসিয়ে রাখাটা কঠিন কাজ হতে পারে, তা আগেই ভাবা উচিত ছিল নির্মাতাদের।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রাইম এজেন্সির খালি সিংহাসনে বসবে কে, তাই নিয়ে ষড়যন্ত্র, রেষারেষি। অন্য দিকে, মুম্বইয়ে ঘটে যাওয়া কোটি টাকার চুরির তদন্ত করতে নামে মুম্বই পুলিশ। চোর-পুলিশ খেলা শুরু হতেই আরম্ভ হয়ে যায় পিঠে ছুরি মারার খেলাও। একটি ব্ল্যাক বক্সের খোঁজে নেমে পড়ে হিরো-ভিলেন সকলে, যা দিয়ে কোন রাজকোষের সন্ধান পাওয়া যাবে, ঈশ্বরই জানেন! দর্শককে গোড়া থেকেই ধাঁধিয়ে দেওয়া হয়, আসল-নকল চেনার ফিকিরে। চেনা টুইস্ট হলেও তা এত অতি-ব্যবহৃত, তাতে চমকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গৌরচন্দ্রিকা শেষ করতে করতেই চলে আসে ইন্টারভ্যাল। বিরতির ঠিক আগের মোচড়টুকু ছাড়া পুরো প্রথমার্ধ অহেতুক দীর্ঘ ও একঘেয়ে। প্রভাসের নায়কোচিত এন্ট্রি, একা হাতে একশো ভিলেন নিকেশ করার পরেও কিন্তু হাততালি পড়ে না! স্ক্রিন প্রেজেন্স থাকা সত্ত্বেও দু’বছর আগের প্রভাসের ‘এক্স ফ্যাক্টর’ কাজ করল না এ বার। বাদ সাধল তাঁর হিন্দি উচ্চারণও। শ্রদ্ধা কপূরের সঙ্গে কেমিস্ট্রিও জমল না তেমন। গোটা ছবিতে কখনওই দু’জনকে জুটি হিসেবে খুঁজে পাওয়া গেল না। শ্রদ্ধা এখানে পুলিশ অফিসার। শুরু থেকেই ডিপার্টমেন্টে মজার পাত্র হতে হয় তাঁকে, ‘মেয়ে’ বলে। তাই কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। যদিও শেষে গিয়ে দেখা গেল, তার রক্ষাকর্তাও সেই নায়কই! সাহোর প্রেমে পড়াটাই যেন মোক্ষ হয়ে দাঁড়াল তার কাছে। আপাত দৃষ্টিতে স্ক্রিপ্টে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা রয়েছে। অথচ সারা ছবিতে নারী চরিত্র মাত্র তিনটি! কাজেই ‘আন্ডারকভার’ থাকায় শ্রদ্ধার চরিত্রটি পুলিশ অফিসারের খোলস ছেড়ে হঠাৎ ডিস্কোয় নাচতে শুরু করবে, এ আর আশ্চর্য কী! যে উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার চরিত্রটির আমদানি, তাতে জল ঢেলে দেয় নায়িকার লাস্যময়ী অবতারে প্রভাস ও তার শাগরেদদের অভিব্যক্তি!
সাহো
পরিচালনা: সুজিত
অভিনয়: প্রভাস, শ্রদ্ধা,
নীল, চাঙ্কি, জ্যাকি
৪/১০
মন্দিরা বেদীকে তা-ও খানিকটা জায়গা দেওয়া হয়েছে স্ক্রিপ্টে। তবে আইটেম ডান্সে জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ় এবং অপ্রয়োজনীয় চরিত্রে ইভলিন শর্মাকে নেওয়া নেহাতই বাহুল্য। টিনু আনন্দ, প্রকাশ বেলাওয়াড়ি, মুরলী শর্মার মতো অভিনেতাদের ঠিক মতো ব্যবহার করা হয়নি। টিপিক্যাল ক্যারিকেচারিশ ভিলেন হয়েই রয়ে গেলেন তাঁরা। নীল নিতিন মুকেশ, চাঙ্কি পাণ্ডেরাও তেমন জমাতে পারলেন না।
হলিউডের সেরা স্টান্ট ডিরেক্টররা কাজ করেছেন এ ছবিতে। কেনি বেটসের মতো বিখ্যাত নামও রয়েছে। এক একটা স্টান্ট দৃশ্যে ৭৫ কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ করা হয়েছে। একমাত্র চেনা মুম্বই শহর ছাড়া বিদেশি ঝলমলে লোকেশন সব মিলেমিশে একাকার। প্রভাসকেও ব্যাটস্যুটটাই শুধু পরাতে বাকি রেখেছিলেন নির্মাতারা! এত করেও শেষরক্ষা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অ্যাকশন, স্টান্ট, ভিস্যুয়ালস যেমনই হোক— গপ্পো না জমলে যে টানটান ব্যাপারটাই মিসিং! হিন্দি ডেবিউয়ের স্ক্রিপ্টটা আর একটু মন দিয়ে পড়লে পারতেন প্রভাস।