বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে ঋতুপর্ণার কথা।
আজ সকাল থেকে শুধু আঙ্কলের হাসির শব্দ কানে বাজছে। আমার আঙ্কল পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ছোটবেলায় ওঁর ছবি দেখে বড় হয়েছি। মনে আছে প্রথম ছবি, ‘গৃহযুদ্ধ’। মমতা শংকর, অঞ্জন দত্ত, গৌতম ঘোষ, অবাক হয়ে দেখেছিলাম। কী সব অভিনয়! অল্প বয়স তখন আমার, কিন্তু ওই ছবি দেখেই মনে হয়েছিল এই পরিচালক বাংলা ছবির রুপরেখায় কিছু বদল আনছেন।
ভাবিনি সেই পরিচালক একদিন আমাকে তাঁর ছবিতে অভিনয় করার জন্য ডাক পাঠাবেন। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা। আঙ্কল জানিয়েছিলেন আমাকে একজন পরিণত যৌনকর্মীর অভিনয় করতে হবে যার সন্তান আছে। উনি তখন ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ তৈরি করছেন। খুব চ্যালেঞ্জিং চরিত্র ছিল আমার জন্য। কাজ করতে গিয়ে অনেক বকা খেয়েছিলাম। একেবারেই অন্য ধারার পরিচালক ছিলেন, তাই মাঝে মাঝে মনে হত এত দিন ধরে একটা ছবির সঙ্গে থেকে কী করছি আমি! কিছুই বুঝতে পারছিনা! আলো পছন্দ না হলে উনি শ্যুট বাতিল করে দিতেন। সেজেগুজে বসে রইলাম, কিন্তু কাজ হল না। তখন অল্প বয়স ছিল, হতাশ হয়ে যেতাম। এখন বুঝি আমার অভিনেত্রী সত্তাকে কেমন করে নির্মাণ করেছিলেন তিনি। পুরুলিয়া ছিল ওঁর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। ওই লালমাটির রুক্ষতা চরিত্রগুলোর মধ্যে মিশিয়ে ছবিতে অদ্ভুত একটা কাব্যময় প্রেক্ষিত তৈরি করতেন। ওঁর ছবি তাই শুধু বাংলায় নয়, বিদেশের মানুষের কাছেও বরাবর সমাদৃত হয়েছিল।
আমায় কোনও দিন ঋতু বলে ডাকেন নি। সব সময় বলতেন ঋতুপর্ণা। ওঁর মেয়েরা আমার বন্ধু ছিল। আমাকে তাই মেয়ের মতোই দেখেছেন বরাবর। ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর খুব আনন্দ হয়েছিল আমার। বুঝেছিলাম কেন উনি বকতেন! কেন এত পরিশ্রম করিয়েছিলেন। আঙ্কল যখন ‘উত্তরা’ করছেন তখনও আমার ডাক এসেছিল। সে সময় এত অন্য ছবির চাপ ছিল, আমি কোনও ভাবেই ‘উত্তরা’য় কাজ করতে পারলাম না। এই আফসোস আমার চিরজীবনের।
আলো আর আকাশ পাগল মানুষ ছিলেন আঙ্কল। মনে আছে ভোর সাড়ে তিনটে আমাদের কল টাইম ঠিক হল। রাত যেখানে দিনের সঙ্গে মিশছে ওই আলোটা ওঁর চাই, ওই আলো উনি ধরে রাখবেন। সকলের আগে শ্যুটের জায়গায় পৌঁছে যেতেন। আড়াইটা থেকে আমরা সেজেগুজে প্রস্তুত। ভোর শুরু হল। শ্যুটও আরম্ভ হল। একটু দিনের আলো বাড়তেই দেখি আমাকে দেখার জন্য শ্যুটের জায়গায় অজস্র লোক ভিড় করেছে। আঙ্কল বেশ রেগে গেলেন, বললেন “তুমি যে এত জনপ্রিয় আমি তা জানতাম না! আমার ছবি করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।”
ঠোঁটকাটা মানুষ ছিলেন। বুঝিয়ে দিলেন আমার এই জনপ্রিয়তা ওঁর একেবারেই পছন্দ নয়। বরাবরই খেয়াল করে দেখেছি চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে একেবারে অন্য রকম বোধ কাজ করতো ওর। দর্শকের পছন্দ হবে বলে কোনও দিন কোনও ছবি তৈরি করেননি। আবার তেমনি ক্যামেরার উল্টোদিকে কোন নায়ক বা নায়িকা আছেন, তা নিয়ে তিনি কোন দিন মাথা ঘামাননি। সেলুলয়েড ছিল ওঁর জীবনের প্রথম এবং শেষ কথা।
আজ হয়তো আলো ভরা কোনও ফ্রেমের সন্ধানে আকাশে পাড়ি দিলেন আঙ্কল।