ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং সঞ্জয় চক্রবর্তী।
সিঙ্গাপুর থেকে মুম্বই এসেছি জুনের ২২। ছবির কাজে যোগ দিলাম জুলাইয়ের তিন তারিখ। এই অতিমারি সময়ে মাঝের দিনগুলো গেল টিকা, টেস্ট ইত্যাদিতে। এসেছি বীণা বক্সীর ‘ইত্তর’ (আতর) ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য। এই ছবিতে আমার বিপরীতে আছেন দীপক তিজোরি। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই তো আর শ্যুটিং শুরু হয় না! অভিনয়ের কর্মশালা, পোশাক ঠিক হল কি হল না তার মহড়া, রূপসজ্জার টেস্ট-- অনেক কাজ থাকে একটি ছবি ফ্লোরে যাওয়ার আগে। এই সব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তা হলে ঝড়ের বেগে কলকাতায় এলাম-গেলাম কখন? দুই মা আমাকে এমন করে ডাকলেন! এক জন অসুস্থ, অন্য জন পাঁচ মাস পরে আমাকে দেখার জন্য অস্থির।
শাশুড়ি-মা পড়ে গিয়ে কাঁধে আঘাত পেয়েছেন কয়েক দিন আগে। নার্সিংহোমে অস্ত্রোপচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে এই বয়সে। ধকলে শরীর ভাল নেই তাঁর। পরিবারে দুশ্চিন্তার ছায়া। সঞ্জয়ের পক্ষে এখন আসা অসম্ভব। এত কড়াকড়ি বিধিনিষেধ সিঙ্গাপুরে! এত বাধা চারদিকে! ভাবলেই হতাশ হয় মন। কিন্তু যে পরিস্থিতিই হোক, জীবন নিয়ে এগিয়ে চলতেই হবে। জীবন থেমে থাকবে না। এটাই নিয়ম। তাই হাল ছাড়লে চলবে না। চিত্রনাট্য পাঠের সেশন থেকে বেরিয়ে মুম্বইয়ের ইমারজেন্সি কোভিড সেন্টার থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট নিয়ে কলকাতার বিমান ধরেছিলাম। আশঙ্কা আর চিন্তা ছিল। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তারদের সহযোগিতা ও চেষ্টায় শাশুড়ি-মা ভাল হয়ে উঠছেন দেখে আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
এর পর মায়ের কাছে। মায়ের সঙ্গে কয়েক মাস পর দেখা হওয়ার অনুভূতি এতটাই সুন্দর যে কী বলব! মনে হল মাকে যেন আবার নতুন করে দেখলাম। ফোনে মা বলত, “তোদের সঙ্গে কি আর কোনও দিন দেখা হবে আমার?” সত্যি, অতিমারি যে কবে পুরোপুরি কাটবে! কত দিন পরে মায়ের পাশে শুয়ে থাকলাম। সুখ-দুঃখের গল্প করলাম। টুকিটাকি অনুযোগ শুনলাম। মায়ের মনের কথা, রাগ, দুঃখ, অভিমান ভাগ করে নিলাম। অনেক দিন পর মা আমাকে পেল। আমিও মাকে। যদিও ঝটিকা সফর, তবুও মায়ের মন কিছুটা হলেও শান্তি পেল তো! আমার কোভিড হয়েছিল সিঙ্গাপুরে।
স্বামী সঞ্জয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ঋতুপর্ণা
প্রথমে হাসপাতাল, তারপর রিকভারি সেন্টার-- মা সবই শুনেছিল। কিন্তু অনেক দূর থেকে। নিজের চোখে দেখতে পায়নি। পাশে থাকতে পারেনি। আমাকে নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় দিন কেটেছে মায়ের। অনেক দিন পর আমাকে দেখে প্রথমে মায়ের কী কান্না! আবেগে জড়িয়ে ধরে আর ছাড়ছিল না মা। আমিও ভিজে উঠেছিলাম। মা জানত এখন ভাত-রুটি বেশি খাচ্ছি না। তাই চিকেন সুপ, সবজি। মা বলল, “তোর প্রিয় হিংয়ের কচুরি, লুচি আলুর দম পরের বার বানাব। তখন বেশি ডায়েট করিস না। শ্যুটিং একটু কম রাখিস।” মায়েরা এমনই। কত কিছু মাথায় রাখে। তবে এ বার আমার সবচেয়ে বড় পাওনা প্রিয় ঠাকুমার নিজের লেখা ডায়েরি হাতে পাওয়া। মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। অনেক দিন ধরেই এটা খুঁজছিলাম। গত দু'মাস মায়ের শরীর খারাপ ছিল। এখন ভাল আছে অনেকটা, এটাই আমার কাছে আনন্দের।
মায়ের পাশ থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আর সময় নেই। ফিরতে হবে মুম্বইয়ে ‘ইত্তর’ ছবির কাজে। উড়ান ঝড়-বৃষ্টিতে পাঁচ ঘণ্টা লেট। বাসায় ঢুকলাম রাত সাড়ে ১২টায়। ভোর পাঁচটায় কল-টাইম। কোভিড বিয়ে কড়াকড়ি অনেক। তার পর শুরু হবে চেনা যুদ্ধ। কাজ আর কাজ। সামান্য সময়ের বিশ্রাম।
আধো-ঘুমে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল কলকাতায় দুই মাকে দেখতে যাওয়া নিয়ে। দুশ্চিন্তা নিয়ে অসুস্থ শাশুড়ি-মাকে দেখতে এসেছিলাম। আর অস্থিরতা নিয়ে নিজের মায়ের কাছে গিয়েছিলাম এত দিন পর মায়ের মেয়েকে দেখাতে!
দুই মা আমাকে দুই ভাবে দেখছিলেন।
দু’জনের চোখে দু'রকম ভালবাসা আর অভিমান।
ঘুম হল না। ঘোরের মধ্যে জেগে থাকলাম।