ঋষি কপূর
ঋষি কপূর ভাল বাবা, আদর্শ স্বামী বা সুপুত্র হতে এই পৃথিবীতে আসেননি। তিনি শীলিত বক্তাও ছিলেন না। নায়ক রূপে আত্মপ্রকাশের কিছু দিন পরেই সেলিম-জাভেদের সঙ্গে ঝগড়া করে ফেলেছিলেন। রাজ কপূর মনে করতেন, ছেলে যে একক নায়ক রূপে সে ভাবে সুযোগ পাচ্ছেন না, এই খটাখটি তার অন্যতম কারণ। ঋষির নিজের খেদ, অসম্ভব বুদ্ধিমান শিল্পীর তকমা তিনি কখনওই পাননি। মনমোহন দেশাই যখন তাঁর কাছে ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’র প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তিনি শোনা মাত্র না করে দেন। বলেছিলেন, আমার দাদাজি আকবরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, ম্যায় কিঁউ করু? পরে বলেছেন, সিনেমার নাম শুনে ভেবেছি, অমর কোনও গেঁয়ো বাঁশিওয়ালা। তার সঙ্গে সিজারের সহযোগী মার্ক অ্যান্টনি আর আকবর বাদশাকে জুড়ে আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। মনমোহনকে পাগল বললেন ঋষি, আর ‘মনজি’ সবাইকে বললেন চিন্টু এক নম্বরের বুদ্ধু। তার পর কপূরদের লাডলা যখন সেটে কাঁটায় কাঁটায় ঢুকে কোনও আগাম প্রস্তুতি, হোমওয়র্ক ছাড়া স্রেফ সরু একটা গোঁফ, তাবিজ, সাদা পাঠানি, লাল ফেজ চড়িয়ে পাক্কা সড়কছাপ আকবর ইলাহাবাদি হয়ে গেলেন, মনজি তাজ্জব। আদ্যোপান্ত অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা অনেকখানি ঋষি কপূরের হয়ে গেল প্রতিভার রফু চক্করে।
সত্তর দশকে যাঁদের হাত ধরে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ‘বলিউড’ আখ্যা পায়, মসালা ফিল্ম মাস্টার মনমোহন দেশাই তাঁদের অন্যতম। তাঁর সিনেমা বোধের জবাব নেই, তাঁর পশরায় রং আর বৈচিত্রের শেষ নেই। বিনোদনের এই গুরুমশাই যদি ঋষিকে না বুঝে উঠতে পারেন, তবে বাকিদের দোষ কী? ঋষি কপূরকে তাঁর ঐশ্বরিক অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করলে বলেছেন, ‘শ্রী ৪২০’ ছবির পেয়ার হুয়া, ইকরার হুয়া গানে প্রথম ক্যামেরার সামনে এসেছি। ওই পরিবারে জন্মে এটুকু মাত্র অভিনয় পারি, সেটা কম লজ্জা? পুলিশের ছেলের কাছে হাতকড়া যা, কুমোরের ছেলের কাছে মাটির তাল যা, অভিনয় আমাদের কাছে তাই।’’
আপনার তেলেবেগুনে মেজাজ নিয়ে এত কথা হয় স্যর, আপনি তো দেখছি আচ্ছা বিনয়ী! সিনেমার ইতিহাস সাক্ষী, রাজ কপূরের শোম্যানশিপ, শাম্মির নাচের ক্যারিশ্মা আর শশী কপূরের রমণীমোহন লালিত্যের মিলমিশের শ্রেষ্ঠতম বিন্দু তো আপনিই। ১৯৫২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বলিউডের ফার্স্ট ফ্যামিলিতে যে জন্মেছিল সে শুধুই রাজ-কৃষ্ণার তৃতীয় সন্তান নয়, শুধুই বলিউডের প্রথম চকলেট হিরো নয়। সে ওই পরিবারে জন্মানো সব তারকার অন্যতম সেরা অভিনেতা।
লতার কোলে খুদে ঋষি।
অমিতাভ বচ্চন এমনি এমনি চুরমার হয়ে যাওয়া টুইটটা করেননি। এই ঋষিই তাঁকে বলতেন, তুমি তো ছবি ছিনিয়ে নাও। অমিত অভিমানী ছেলেটার উপর রাগ করতে পারেননি। নায়ক হওয়ার আগেই ‘মেরা নাম জোকার’-এ স্রেফ চোখ দিয়ে কথা বলে এই ছেলে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাজে না। তখন রাজেশ খন্নার রোম্যান্স সাম্রাজ্য তাঁর অ্যাংরি ইয়ংম্যান রাজদণ্ডের কাছে পরাজিত। বলিউডের যে দিকে তাকাই শুধু তিনি। মাচো, রোমশ, মেঘমন্দ্র স্বর, কঠিন। যুগধর্ম মেনে নায়করা প্রায়শই ত্রিশোর্ধ্ব, কেউ কেউ আরও বেশি। পঞ্চাশ-ষাট দশকের স্বর্ণযুগের অনুসরণে তখনও অভিনয়ে লার্জার দ্যান লাইফ রীতির রেশ। দর্শক অজান্তেই সেই রেট্রোসেক্সুয়াল বোতলে বন্দি, ঠিক তখন এই ‘রাজ’পুত্র তাঁর স্বর্গীয় চার্মের রেশমি পালক বুলিয়ে দিলেন পর্দায়। সজল দুর্বাদলের মতো দেহপল্লব, টুকটুকে ঠোঁট, চোখের তারায় নক্ষত্রের ঝিলিক। হাসলে যুবতীর মনে কিশোরীর পূর্বরাগ, কথা বললে আতর ঝরে। স্বপ্নপুরুষ। সে হয়তো থাকে শহুরে প্রাসাদে, বাহন লম্বা গাড়ি, চোখে ওভারসাইজ়ড সানগ্লাস, পরনে বেলবটমস, কাঁধে গিটার। ‘হাম কিসিসে কম নহি’র রাজেশ। কিংবা সে মলিনবেশী ভাগ্যবিড়ম্বিত অনিন্দ্যকান্তি। ‘আপ কে দিওয়ানে’র রাম। খুব নিশ্চুপে রমরমে অমিতাভ-যুগের সমান্তরালেই বলিউডের নব্য-ঘরানার সূচনা করে দিয়েছিলেন ‘ববি’র রাজ, ‘কভি কভি’র ভিকি। টিন-এজ প্রেমলাভার-বয়, চাইল্ড-ম্যান হিরোর ঘরানা। চিন্টুবাবার দেখানো এই রাস্তাতেই এসেছেন ‘লাভ স্টোরি’-র কুমার গৌরব, ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’র আমির, ‘রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান’-এর শাহরুখ। এই সময়ে ঋষি-অভিনীত চরিত্রগুলো কিন্তু একে অপরের চেয়ে তেমন একটা আলাদা নয়। কিন্তু যেহেতু বলিউড তখন অনেক ধারায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, রোম্যান্স, কমেডি, সোশ্যাল ড্রামা, থ্রিলার, ঐতিহাসিক ছবি— প্রাণ খুলে জাত চেনাবার সুযোগ পেয়েছিলেন অভিনয়ের বরপুত্র। সিনেমার অর্ধেকটায় নায়ক মেয়ের বেশে! তিনি ছাড়া আর কোনও নায়ক সে যুগে ক্রসড্রেসিংয়ের দুঃসাহস দেখাতে পারত কি! আর এই মেট্রোসেক্সুয়াল ইমেজ নিয়ে চিন্টু এসে না দাঁড়ালে আর ডি বর্মণ কি এতখানি আরডিএক্স হতে পারতেন! এক মে অউর এক তু, বচনা অ্যায় হাসিনো, হোগা তুম সে পেয়ারা কৌন: ঋষি কপূর ছাড়া যে নিষ্প্রাণ!
আরও পড়ুন: আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম: অমিতাভ
আশির দশককে কয়েক জন ফিল্ম পণ্ডিত বলেন বলিউডের অন্ধকার যুগ। নিশ্চিত ভাবে এই তথ্যকে অসাড় করতে পারে পরিণত ঋষির বেশ কিছু সিনেমা। বোধহয় এই পর্ব থেকেই তিনি পরিণত অভিনেতা হয়ে ওঠেন। একার কৃতিত্বে হল ভরিয়ে দেন ‘প্রেম রোগ’, ‘কর্জ়’, ‘নসিব অপনা অপনা’য়। ‘নাগিনা’, ‘সাগর’ বা ‘চাঁদনি’-তে লিড হিরো তিনি। ঈষৎ পৃথুল তিনি তখন, চল্লিশ ছুঁইছুঁই নায়ক। কিন্তু ওই নরম চাহনির যে কোনও বয়স হয় না, তার প্রমাণ মিলল যখন নব্বইয়ের শুরুতে হাঁটুর বয়সি দিব্যা ভারতীর কাছে গিয়ে জাদু-অভিব্যক্তিতে গাইলেন, ‘সোচেঙ্গে তুমহে পেয়ার করে কে নেহি’। তাঁর শরীরে-লাবণ্যে-তারুণ্যে তখন ক্রমশ অত্যাচারের থাবা, তবু তাঁর প্রিন্টেড সোয়েটার-শার্ট বা জার্সি টিগুলো দোকানে দোকানে ঝুলত।
আরও পড়ুন: আজন্ম প্রেমিক নায়ক ছিলেন ঋষি, আরও বিবর্ণ হল বলিউড
তিনি ভাগ্যবান ও বুদ্ধিমান। টেনেটুনে নায়কের চরিত্র করে যাওয়ার জেদ করেননি। এ দিক দিয়েও সমসাময়িক, অগ্রসূরিদের অনেককেই হারিয়েছেন। সহস্রাব্দের শুরুতে তিনি চরিত্রাভিনয়ে সরে আসতে তাঁর প্রতিভার সাত রং যেন ঠিকরে বেরোল। চেহারাযন্ত্র ও স্বরতন্ত্র ব্যবহার করে তাঁকে অভিনয়ের শিখর ছুঁতে দেখলাম আমরা। সেফ, সলমন, কাজল-- দশ-পনেরো বছরের ছোট অভিনেতার বাবার চরিত্র করতে তাঁর ইগোয় বাঁধে না। নতুন বলিউডের হাতে চাঁদ। ‘অগ্নিপথ’-এ বিশাল চেহারা নিয়ে সঞ্জয় দত্ত যতই ভয় দেখান, সেরা ভিলেনের অ্যাওয়ার্ড নিয়ে গেলেন রউফ লালা। ‘চশমে বদ্দূর’-এর রোম্যান্টিক প্রৌঢ়, ‘কপূর অ্যান্ড সনস’-এর মিষ্টি দাদু, ‘’১০২ নট আউট’-এ ৭৫ বছরের ভিতু বুড়ো ছেলে... কত চরিত্র যে রঙিন করে দিয়ে গেলেন!
আরও পড়ুন: ঋষির সঙ্গে শেষ দেখা আর হল না : হেমা মালিনী
‘’স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’’-এ তিনি সমকামী প্রিন্সিপাল! ‘দো দুনি চার’, ‘মুলক’-এ হৃদয় ছুঁয়েছেন। দর্শক পরম মমতায় প্রশ্ন করেছে, আচ্ছা চিন্টুজি কি ব্যক্তিগত জীবনেও এমনিই সুইটহার্ট? ‘রাজ়মা চাউল’-এ ছেলের প্রেম করানোর জন্য তিনি তার পছন্দের মেয়েটির দোকানে ঢুকে ফেশিয়াল করাচ্ছে, শেষ সিনেমা ‘দ্য বডি’-তে দাপুটে পুলিশ অফিসার কী ভাবে যেন প্লটের মূল চালক হয়ে উঠছে! এই ঘাতক ৩০ এপ্রিল ২০২০-র পর আপনাকে ছাড়া আমরা কী করব বলুন ঋষি সাহাব!
সেলাম সেলাম সেলাম! আর সলমন খানের কথা ধার করে বলছি, সব কহা-শুনা মাফ হো। পিতা-পুত্র-স্বামী হিসাবেও বহু কথা শুনেছেন আপনি! আপনি যে এই সব জাগতিক হিসেব-নিকেশ করতে আসেননি। আপনি শুধু অভিনয় করতেই জন্মেছিলেন। আজ শেষ বেলায় কর্কটে দগ্ধে দগ্ধেও স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণবন্ত অভিনয়ের শেষ রাজপুত্র থেকে গেলেন আপনি। লোকে দুঃখ করছে, এত বড় সুপারস্টারের এ কি নিশ্চুপ অনুজ্জ্বল বিদায়! কোথায়! শেষকৃত্যে আপনাকে ঘিরেছিল যাঁরা তারা তো একলাই বলিউড। সইফ, করিনা, অভিষেক, নীতু, রণবীর। আর আপনাকে বিদায় জানিয়েছে নিস্তব্ধ নির্বাক মায়ানগরী। যার সাগরপারের রং ভরে বাদল মে এখনও আপনার শরীর-ভস্মের আতর-সুগন্ধ উড়ছে। উড়ছে বলিউডের পাতাগুলো।
... এক দিওয়ানা থা... কেয়া উমর, কেয়া সমা, কেয়া জ়মানা থা...
আরও পড়ুন: বাবাকে শেষ দেখা দেখতে দিল্লি থেকে গাড়িতে মুম্বই পাড়ি রিধিমার