ইরফান
গোটা পাঁচতারা হোটেলে কোথাও বসার জায়গা পছন্দ হচ্ছে না তাঁর। শেষমেশ পুলসাইড এরিয়া, সেখানে আবার একটি চেয়ারও পাতা নেই। ধুপ করে একটা উঁচু ধাপিতে বসে সামনের দিকে আয়েশ করে পা ছড়িয়ে সিগারেটটা ধরালেন। বোঝা গেল, কেন খোলা বাতাস চাইছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘‘আপনার এখানে বসতে একটু অসুবিধে হবে হয়তো... কিন্তু ইন্টারভিউটা এখানেই সেরে ফেলি, কী বলেন?’’ জীবনে প্রথম বার ইরফান খানের সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া সাংবাদিক তখন ধাপার মাঠে বসতেও রাজি! ‘গুণ্ডে’ ছবির জন্য সেই প্রথম বার ইরফান খানের সঙ্গে মোলাকাত। কথাবার্তা খানিক এগোতেই বোঝা গেল, উনি কম কথা বলেন কিন্তু যেটা বলেন সলিড... খণ্ডন করা যায় না। এটাও বুঝেছিলাম, লোকটা অসম্ভব ভদ্র আর সহজ ভাবে মিশতে পারেন।
বুধবার সকালে ইরফানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে উঠেছিল শোকবার্তায়। সকলের একটাই কথা, মাটির কাছাকাছি থাকা একটা মানুষ। আর একটা জিনিসও ইরফান পারতেন, মাটি কামড়ে লড়াই করতে। যে লড়াইয়ের কথা সুজিত সরকার তাঁর টুইটে উল্লেখ করেছেন। প্রিয় বন্ধু, অভিনেতার মৃত্যুতে এতটাই ভেঙে পড়েছেন ‘পিকু’র পরিচালক যে জানালেন, কথা বলার মতো অবস্থা নেই তাঁর।
দু’বছর ধরে মারণরোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। একটা ছবির শুটিংও করেছেন। ইরফানের মেডিকেল বোর্ডে এক পরিচিত চিকিৎসক ছিলেন। অভিনেতার অসুস্থতার শুরুতেই তাঁর মুখে শুনেছিলাম, এ লড়াই জেতার নয়। অথচ ‘আংরেজ়ি মিডিয়াম’ ছবিটি কী ভাবে একার কাঁধে টানলেন তিনি! ঠিক গত বছর এই সময়ে চূড়ান্ত গরমে উদয়পুরে শুটিং চালিয়েছেন, স্রেফ মনের জোরে। স্ত্রী সুতপা এক জায়গায় বলেছিলেন, ইরফান যাতে ভাল থাকে, সেগুলোও ওকে করতে দিতে হবে।
‘আংরেজ়ি মিডিয়াম’ দেখার পরে বোধগম্য হচ্ছিল না, শরীরের এই অবস্থায় এমন একটা চিত্রনাট্য তিনি কেন বেছেছিলেন? ছবিটির প্রচারে এক সংবাদমাধ্যমকে ইরফান ই-মেল সাক্ষাৎকারে তাঁর ছেলেদের কথা বলেছিলেন। কেন তাদের ইচ্ছেমতো বাড়তে দেওয়া উচিত, কেন সন্তানের উপরে বাবা-মায়ের প্রত্যাশার বোঝা চাপানো উচিত নয়... ছবির মধ্য দিয়েও কি সেটাই আবার বুঝিয়ে দিতে চাইছিলেন?
আরও বার দুয়েক ইরফানের সাক্ষাৎকারের সুযোগ হয়েছে। আনন্দবাজারের দফতরেও তিনি এসেছেন। তবে ‘পিকু’র সেটের ঘটনা মনে থেকে যাবে। সেই সেটে বলতে গেলে ট্রেসপাসার ছিলাম। গঙ্গার ধারে শুটিং হচ্ছিল। শট দেওয়ার পরে দীপিকা পাড়ুকোন কোথায় যেন উবে গেলেন। ইরফান রেল লাইনের ধার দিয়ে এগোচ্ছিলেন। পিছু নিতে বুঝলাম, ধূমপান বিরতি নিচ্ছেন। তাঁর চোখ ঠিক বুঝে নিয়েছিল, এ কোনও সেলফি-শিকারি ভক্ত নয়। কোন কাগজ খোঁজ নিলেন। তার পরের প্রশ্ন, ‘‘একটা ট্রেন এলে আমি যদি উঠে চলে যাই। তা হলেও কি পিছু নেবেন?’’ কোনও সাংবাদিক এমন সুযোগ কি ছাড়ে?
কিন্তু ইরফান যে সত্যিই এ ভাবে চলে যাবেন, তা কে ভেবেছিল!
আরও পড়ুন: আমার আকাশে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ইরফান