সমাজমাধ্যম ব্যবহার করেন না তিনি। তাঁর বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন পুত্র ঋদ্ধিই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে চাইলেই একজন শিল্পীর গায়ে হাত তোলা যায়! না কি শাহরুখ খান বা অমিতাভ বচ্চন না হলে অভিনেতারা হেলাফেলার পাত্র? এই সব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে শহরের আনাচেকানাচে। ধিকিধিকি জ্বলছে আঁচ। যে প্রতিবাদের আগুন গতকালই জ্বালিয়েছেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য, এ বার সেই আগুনে একে একে ঘি ঢালছেন শহরের অন্য শিল্পীরাও। বৃহস্পতিবার মুখ খুলেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব তথা তরুণ অভিনেতা ঋদ্ধি সেন। শুক্রবার সরব হলেন তাঁর পিতা, কৌশিক সেন।
সমাজমাধ্যম ব্যবহার করেন না তিনি। তাঁর বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন পুত্র ঋদ্ধিই।
কৌশিক বলছেন, “ক্ষমা করবেন, জানি, যে কোনও বিষয় বা একটা প্রসঙ্গ খুব চট করে আজকাল ফুরিয়ে যায়, অথবা হয়ে পড়ে ‘ মরচে পড়া পেরেকের’ মতো ভোঁতা। ২৪শে ডিসেম্বর ২০২২-এ কল্যাণীতে একটি নাটকের অভিনয় করতে যাওয়ার সময় যে খবরটা পেয়েছিলাম, সেটা হতে পারে ‘কেক বনাম থিয়েটার’ কিংবা ‘ক্ষমতা বনাম থিয়েটার, অথবা ‘অসভ্যতা বনাম সভ্যতা’। শিরোনাম যা-ই হোক না কেন, মারটা জুটেছে ‘বিদূষক নাট্যমেলা'র ভাগ্যে। ”
অভিনেতা অমিত সাহাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ‘বিদূষক নাট্যমণ্ডলী’র নাট্যোৎসব বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে। যার প্রতিবাদে একজোট হয়েছেন কলকাতার শিল্পীরা। চলচ্চিত্র পরিচালক থেকে শুরু করে পর্দা, মঞ্চের অভিনেতা এবং নাট্যব্যক্তিত্বরা লাগাতার বিক্ষোভ জানাচ্ছেন সমাজমাধ্যমে। তবে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল অভিনেতা তথা পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ক্ষুরধার আক্রমণে। অনির্বাণ লেখেন, “চলুন, আমরা নাটক ছেড়ে একটা মার খাওয়ার উৎসবের দিকে এগিয়ে যাই।’’ বাংলার রাজনীতিই যদি শিল্প সৃষ্টির অন্তরায় হয়, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে নামা ছাড়া উপায় নেই বলেই মনে করছেন অনির্বাণ। সেই সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঋদ্ধি লিখেছিলেন, “নাট্যোৎসবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে এরা দেখিয়ে দিল যে মানুষের থেকে কেকের মূল্য বেশি। সদ্য গজিয়ে ওঠা উৎসবের ভিড়ে আরেকটা উৎসব জুড়ে দেওয়া হোক, গণধোলাইয়ের উৎসব। যুক্তি আর বুদ্ধি চিতায় তুলে সব শাসকদল গায়ে হাত তোলে, আবার তুলবে, বার বার তুলবে। আমরা ব্যর্থ, নির্লজ্জ, হতভাগ্য জনগণ।"
পুত্রের পাশে প্রতিবাদী স্বর তুললেন পিতাও। শুক্রবার দীর্ঘ বার্তায় কৌশিক বললেন, “বেলেঘাটায় একটি দু’দিনের নাট্যোৎসব করতে গিয়ে এই ঘটনা। ২৪ তারিখ এবং তারও পরে আরও দু’-তিন দিন কয়েকটা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে মৌখিক প্রতিবাদ জানানোর অথবা অমিত সাহাকে ভিডিয়োবার্তা পাঠানোর পরও দেখলাম প্রসঙ্গটা পুরাতন হচ্ছে না , বরং আরও নানান ভঙ্গি এবং চেহারায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আর হচ্ছে বলেই ঘটনাটা ‘ভুলছি না ভুলব না’-গোছের একটা স্লোগান হয়ে পাক খাচ্ছে মাথায়।”
কৌশিকের দাবি, শাসকদল অস্বীকার করবে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু শাসকঘনিষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্বরা তাই বলে চুপ করে থাকবেন? নাট্যব্যক্তিত্ব তথা অভিনেতার শ্লেষ মিশ্রিত তির গিয়ে পড়ল সেই শিল্পীদের দিকেই, যাঁরা আর এক শিল্পীর অবমাননায় এখনও নীরব। কৌশিক বলছেন, “তৃণমূল কংগ্রেস শুনলাম পুরো ব্যাপারটাই অস্বীকার করেছে, যেমন সমস্ত রাজনৈতিক দল করে থাকে। এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেইl বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে, তৃণমূলের অতি নিকট অথবা সামান্য দূরে কিংবা খুব কাছাকাছি যে সকল ‘নাট্যজনেরা’ আছেন তাঁরা ধ্বংসের আভাসটা পেয়েও নিশ্চুপ, কারণ প্রতিবাদটা করলে ‘মাস্তান রাজনৈতিক কর্মীরা’ খানিকটা কোণঠাসা হবেন l না হলে আজ বিদূষক নাট্যমণ্ডলী কাল নাট্য আকাডেমির সভ্যরা অথবা খোদ সভাপতি কিংবা ভজন-কীর্তন আবিষ্ট যে কোনও নাট্যদল আক্রান্ত হতে পারেন , তৃণমূলী ভাবাবেগ কখন কাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কে বলতে পারে, আর বঙ্গে তো উৎসবের অভাব নেই, যত উৎসব, তত ক্ষমতা আর যত ক্ষমতা, তত গর্জন। এই ঘটনা ভুলতে দেওয়া যাবে না, তাই আমরা আমাদের প্রতিটা নাটকের অভিনয়ের পর এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাব।”