A Suitable Boy

সৎপাত্রের সন্ধানে নেই সৎসাহস

নামে হলেও বিক্রমের উপন্যাস কিন্তু শুধু ‘এক সৎপাত্রের সন্ধান’ ছিল না। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের স্বরূপ বোঝার সন্ধান। সিরিজ়ের অবশ্য সে সব মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণের পরিসরও নেই এখানে। আছে শুধু চটকদার সেট আর একগুচ্ছ দক্ষ অভিনেতা।

Advertisement

সীমন্তিনী গুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২০ ০০:১৫
Share:

‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?’ প্রান্তিক মানুষ কি (নিজের) কথা বলতে পারে? এই নামে সাহিত্য সমালোচক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের লেখা একটি প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, নেটফ্লিক্সে মীরা নায়ারের নতুন সিরিজ় ‘আ সুটেবল বয়’ দেখতে দেখতে।

Advertisement

অতিমারি আবহে গত কয়েক মাস ধরে সিরিজ় গুলে খাওয়া এক দর্শক হিসেবে এই মনে পড়াটা বেশ হাস্যকর। কারণ হিন্দি, ইংরেজি বা বাংলা—দর্শক ধরে রাখার জন্য সিরিজ়ে থাকে রহস্য, হিংসা, প্রেম, গান, যৌনগন্ধ... এ সবেরই সুড়সুড়ি। আর যা-ই হোক, সাহিত্যতত্ত্বের প্রয়োজন পড়ে না!

কিন্তু সিরিজ়ের গল্প যখন বিক্রম শেঠের ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত বহুচর্চিত এবং কিছুটা বিতর্কিত প্রায় দেড় হাজার পাতার উপন্যাস ‘দ্য সুটেবল বয়’, তখন কিছুটা সাহিত্য সমালোচনা তো আনা যেতেই পারে। বলাটা দরকারও, কারণ উপন্যাসটির মূল ফ্লেভার থেকে কয়েক যোজন দূরে মীরা নায়ার পরিচালিত এই সিরিজ়। ভাষা ইংরেজি হলেও ‘ভারতীয় সাহিত্য ভারতীয়ই’, এই মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সব সাহিত্যিকের হাত ধরে, বিক্রম শেঠ তাঁদের অন্যতম। কিন্তু এই সিরিজ় যতই কাল্পনিক ব্রহ্মপুর, কলকাতা এবং লখনউয়ের মতো ‘ভারতীয়’ শহরের পটভূমিতে মেহরা ও দুরানিদের মতো ‘ভারতীয়দের’ গল্প বলার চেষ্টা করুক, ভারতীয়ত্ব খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হবে।

Advertisement

তার একমাত্র কারণ— ভাষা। বিক্রম শেঠ ইংরেজিতেই লিখেছিলেন, কিন্তু পড়তে কোনও অসুবিধে হয়নি। তবে সিরিজ়ের প্রতিটি সংলাপ কানে এত ধাক্কা মারছে কেন? কারণ, যে ইংরেজি সিরিজ়ে ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত ‘মেকি’। ভারতবর্ষের মানুষ কখনও এ রকম কেঠো কেঠো ইংরেজিতে কথা বলেনি, এখনও বলে না। শতাংশের নিরিখে এ দেশে ইংরেজিভাষী দশ শতাংশ, হিন্দির পরেই। সেই দেশে, বিশেষ করে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের যে সময়টাকে উপন্যাসে (এবং সিরিজ়ে) ধরা হয়েছে, তখন এ রকম ‘বুকিশ’ ইংরেজিতে কেউ কেন কথা বলবে, এই প্রশ্ন দর্শকের মনে উঠবেই।

আ সুটেবল বয়
(ওয়েব সিরিজ়)
পরিচালনা: মীরা নায়ার
অভিনয়: তানিয়া, তব্বু, রসিকা, রাম, রণবীর, ঈশান

৪.৫/১০

আর এখানেই আবার ফিরে আসতে পারি স্পিভাকের সেই তত্ত্বে। সিরিজ়ের প্রধান সমস্যা, একটি বিদেশি চ্যানেলের বরাত পেয়ে বিদেশি দর্শকের জন্য এক জন বিদেশিকে দিয়ে চিত্রনাট্য লেখালেন মীরা। ৮৪ বছরের ওয়েলশ-ব্রিটিশ অ্যান্ড্রু ডেভিসের চিত্রনাট্য লেখায় পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত। ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’, ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’, ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর মতো উপন্যাসকে রুপোলি পর্দায় নিয়ে আসতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু বিক্রমের এই উপন্যাসের বেলায় অ্যান্ড্রু এবং মীরা নায়ার— দু’জনেই ডাহা ফেল করলেন। তওয়াইফের চরিত্রে তব্বু থেকে শুরু করে মন্ত্রী মহেশ কপূরের ভূমিকায় রাম কপূর, সকলকে দেখেই বোঝা যায় কৃত্রিম সংলাপের ভারে তাঁরা জর্জরিত। যেটুকু হিন্দি বা উর্দুর ব্যবহার রয়েছে সিরিজ়ে, সেটুকুই যা শুনতে কানে লাগে না। অ্যান্ড্রুর পরিবর্তে যদি কোনও ‘সাবঅল্টার্ন’ ভারতীয়কে দিয়ে সংলাপ ও চিত্রনাট্য লেখার সৎসাহস দেখাতেন পরিচালক, দর্শকের অনেক কাছে পৌঁছতে পারতেন।

আর একটি বড় সমস্যা, বিক্রমের প্রায় ছ’লক্ষ শব্দের উপন্যাসকে পৌনে এক ঘণ্টা করে ছ’টি এপিসোডে ধরার চেষ্টা। উপন্যাস জুড়ে অসংখ্য চরিত্র, ধীরে ধীরে তাঁদের ফুটিয়ে তুলেছিলেন ঔপন্যাসিক। সিরিজ়ের চটজলদি আবহে তা যে সম্ভব নয়, তা-ও কেন বুঝতে পারলেন না মীরা!

নামে হলেও বিক্রমের উপন্যাস কিন্তু শুধু ‘এক সৎপাত্রের সন্ধান’ ছিল না। সেই সন্ধানের আড়ালে লুকিয়ে ছিল আরও বড় এক সন্ধান। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের স্বরূপ বোঝার সন্ধান। সিরিজ়ের অবশ্য সে সব মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণের পরিসরও নেই এখানে। আছে শুধু চটকদার সেট আর একগুচ্ছ দক্ষ অভিনেতা।

হ্যাঁ, যদি সিরিজ়টা শেষ করে উঠতে পারেন, তবে বুঝবেন, পোড়-খাওয়া এক ঝাঁক অভিনেতা— তব্বু, রাম কপূর, রণবীর শোরে, রসিকা দুগ্গল এবং তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চুলবুলে তানিয়া মানিকতালা ও ঈশান খট্টর ছিলেন বলেই আপনার ‘বিঞ্জ ওয়াচ’ শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement