অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
বাবা! আমার ঝড়ের ঠিকানা। আজ জন্মদিনে নতুন কিছু মনে হয় না। যে বাবার নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর তো চলে যাওয়া স্বীকার করিনি আমরা, তাই কোনও মুছে যাওয়া দিন আমার নেই! পিছু ডাক নেই! বাবাকে সামনে থেকে দেখতে পাই। গানকে যারা ভালবাসার তারা যেমন আজও বাবাকে দেখে। নাহ, আকাশ এই তারা ঝড়ে যাওয়ার কথা আজও মনে রেখেছে।
সহজ সাদামাটা সঙ্গীত পাগল আমার বাবা জীবনে ‘খুব সিম্পল’ হয়ে চলার মন্ত্রটা শিখিয়ে গিয়েছিলেন। আজকের ‘শো বিজনেস’ থেকে নিজেকে আলাদা করে তাই স্বাভাবিক রাখতে পারি।
আসলে কোথা থেকে শুরু করব?
একটা মজার কথা বলি, আমার মা বেলা মুখোপাধ্যায় তখন মুম্বইতে, বাবার কাজের জন্য ওখানেই ওদের থাকা। মা তখন অন্তঃসত্ত্বা। মা-র এক মরাঠি বান্ধবী ছিলেন। এক সঙ্গে সিনেমা,শপিং, সবই চলত। বাবা তো গান পাগল মানুষ, মা-র একলা থাকা দূর হতো এ ভাবেই। তো সেই মরাঠি বান্ধবী একদিন মা কে বললেন, “বাঙালিদের এই সময় যেমন খাওয়ানোর রীতি থাকে তেমনই মরাঠিদেরও আছে।” এই বলে তিনি এক বিলাসবহুল হোটেলে মাকে খাওয়ালেন। বলা যায় সাধ খাওয়ালেন। মা পরে সেই বান্ধবীর আন্তরিকতার কথা আমাদের যে কতবার বলেছে। এমনকী স্মৃতিকথাতেও মা লিখেছেন ওই ঘটনার কথা! লেখার মতোই তো! সেই বান্ধবী যে স্বয়ং সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর! দুই পরিবারের কী সাংঘাতিক গানের, প্রাণের সম্পর্ক। কতবার ওঁর বাড়ি গিয়েছি। উনি এসেছেন! আমার জীবনের পরম পাওয়া লতা মঙ্গেশকরকে এত কাছ থেকে দেখা, ওঁর স্নেহ পাওয়া।
আরও পড়ুন, এই ছবিগুলির অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আলিয়া
আমার বাবার মধ্যেও তো একটা পুরদস্তুর বাঙালি বাস করত। কেবল কি সাদা গোটানো শার্ট আর ধুতি? একেবারেই না। লোক খাওয়ানো। বাড়িতে লোকজন আসা যাওয়া, তার মাঝে গান বাজনা— বেশ জমজমাট জীবন ছিল আমার ছোটবেলা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আমার স্বামী গৌতমের সঙ্গে আমার বাবাই আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, “রাণু এই ছেলেটার গান শোন, কী ভাল গায়, ওর সঙ্গে আলাপ কর।” ভাবা যায়? তখন কোন বাবা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড খুঁজে দিতেন?
বাবা খুব চেয়েছিলেন আমি সারা জীবন গান নিয়ে থাকি। বালসারাজী আমার জন্য কী যত্ন করে বাবার উৎসাহে ‘আয় খুকু আয়’ গানটা কম্পোজ করেছিলেন। কত যত্ন করে আমায় গান শেখাতেন বাবা। এই যত্ন শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, কলকাতা, মুম্বইয়ের সব সঙ্গীতশিল্পীরাই বাবার স্নেহের ছায়ায় নিজের কণ্ঠকে উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন! আমার এখনই যেমন মনে পড়ছে কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কথা। বাবাই তো ওঁর নাম সারদা থেকে কবিতা করেছিলেন। মান্না দে- কে ও ওঁর হয়ে বাবা সুপারিশ করতেন। আসলে সুরের জগতে ডুবে থাকা আমার বাবার মধ্যে খুব জটিলতা কোনও দিনই দেখিনি। যে বা যারা সুরের লোক বাবা কেবল তাঁদের সঙ্গে থেকে এগিয়ে দিতেন। সত্যি তো মৌ বনে মধু জমলে মৌমাছিরা কেমন করেই বা দূরে থাকে?মনে আছে বিনোদ মেহরা আর রেখার লুকিয়ে রেজিস্ট্রির সাক্ষী ছিল আমার বাবা।
আরও পড়ুন, মেসি ফেভারিট, আর্জেন্তিনাকে সাপোর্ট করব
বাবার সঙ্গীত জীবনের পঞ্চাশ বছরের উদযাপন নেতাজি ইন্ডোরে। তখন একজন সঙ্গীতশিল্পীকে নিয়ে এত বড় অনুষ্ঠান সচরাচর দেখা যেত না। বাবা চাননি, কিন্তু উদ্যোক্তাদের অনুরোধে বাবাকে ফোন করতেই হল মুম্বইতে। ফোন গেল সুরের সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকারের কাছে। বাবা খুব জড়তা নিয়ে বললেন অনুষ্ঠানে আসার কথা। লতাজি জানালেন, “দাদা আপনার গানের ৫০ বছর, আর আমি আসব না! আমার যত কাজই থাক আমি আসব।” হই হই পড়ে গেল। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে লতাজি জানালেন তিনি আসতে পারছেন না। শরীর হঠাত্ খারাপ। মাথায় হাত সকলের। বাবার পরামর্শে আবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হল লতা মঙ্গেশকর আসতে পারছেন না। কেউ টিকিট ফেরত দিতে পারেন।
অনুষ্ঠানের দিন হাজির। লতাজি আসা না আসা নিয়ে অস্বস্তিতে কলকাতা। ওমা! মঞ্চে হঠাত্ হাজির সরস্বতী। বাবাকে প্রণাম করে বললেন, “দাদা আপনার এই দিনে আমি আসব না! আমি তো সবাইকে প্রণাম করি না, আপনাকে প্রণাম করে শান্তি পাই।”
সে দিন ছিল সব ভাললাগার দিন। কিছু সুর। কিছুটা আবেশে হেমন্ত জাগরণ।
এই হেমন্ত নিয়ে আমার জন্ম, আমার শৈশব, আমার যৌবন আর তাঁকে সামনে দেখতে-দেখতে, শুনতে-শুনতে আমার আত্মা তাঁর মধ্যে মিশে আছে অলখ সুরের সুতোয়।