সত্যজিৎ রায়, নামটাই যথেষ্ট। বাংলা সিনেমা তথা ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপট বদলে গিয়েছিল যাঁর হাত ধরে। শতাব্দীর সেরা চলচ্চিত্রকার যিনি ভারতকে অস্কার এনে দিয়েছিলেন। যাঁর পথ বেয়ে আজও এগিয়ে চলেছে বাংলা সিনেমার জয়গাঁথা। ২ মে তাঁর জন্মদিনে, তাঁকে স্মরণ করলেন একঝাঁক তারকা।
শুধু বিশ্বমানের চলচ্চিত্রকারই নন, সত্যজিৎ রায় ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের সক্রিয় সারথি, বহুমুখী ব্যক্তিত্বের প্রতিভূ। কালান্তরের চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক, স্বর লিপিকার, সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পী, আরও কত কী! সম্প্রতি তাঁর জন্মশতবার্ষীকি উপলক্ষ্যে আনন্দবাজার ডিজিটাল এবং শ্রী সিমেন্টের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এক ভার্চুয়াল সেশন - "তর্পণ: শতবর্ষে সত্যজিৎ রায়"-এর আয়োজন করেছিল প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন।
সেশনটিতে উপস্থিত ছিলেন সেই সমস্ত প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা, যাঁরা সত্যজিত রায়ের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। সেশনটির উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতা সৌমিত্র মিত্র। সেশনটি মডারেট করেছিলেন বাংলার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন দীপঙ্কর দে, মমতা শঙ্কর, গৌতম ঘোষ, উষা উত্থুপের মতো ব্যক্তিত্বরাও। কথায়, গানে, আলাপে, আড্ডার ছলেই সত্যজিৎ রায়কে স্মৃতি রোমন্থন করলেন তাঁরা।
সেশনটি শুরু হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের এক টুকরো কণ্ঠস্বরে। যেখানে উঠে এসেছিল বাংলা তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা আরও এক কবির কথা, যিনি সত্যজিতের জীবনে সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন - তাঁর বাবা সুকুমার রায়।
সত্যজিতের স্মৃতি স্বরণিকা বেয়ে সেশনের প্রত্যেক অতিথিই যেন হারিয়ে গিয়ছিলেন তাঁর সময়ে। যদিও তিনি যে সমস্ত কাজ করেছিলেন সেগুলির সবকটাই সময়, কাল, দেশ এবং মানুষের সীমানার উর্ধ্বে ছিল। তাঁর প্রতিটা কাজ আজও ভীষণভাবে জীবন্ত। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে শ্যুটিংয়ের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করলেন দীপঙ্কর দে। সত্যজিৎ সবসময় বলতেন ডায়লগ নয়, কোনও দৃশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সবসময় সেই দৃশ্যের সঙ্গে ভেসে যেতে হয়। এটি এমন একটি পাঠ ছিল যা তাঁর সমসাময়িক সমস্ত অভিনেতাদের সমৃদ্ধ করেছে।
কিংবদন্তী পরিচালকের সঙ্গে তিনবার কাজ করতে পেরে মমতা শঙ্কর নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। সত্যজিতের পাঠ করা স্ক্রিপ্টগুলি শোনার অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তিনি। অন্যদিকে স্মৃতির স্মরণী বেয়ে, সত্য়জিতে হারিয়ে গিয়েছিলেন গৌতম ঘোষ। তাঁর মতে সত্যজিৎ আসলে সারা জীবন শিক্ষা গ্রহণ করে গিয়েছেন। এমনকি পরিণত বয়সে এসেও তিনি নতুন করে দেবনাগরী ভাষা শিখেছিলেন স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য।
শুধুমাত্র চলচ্চিত্রই নয়, গান এবং সুরেও বিশেষভাবে দক্ষ ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ইন্ডিয়া ক্লাসিকাল এবং ওয়েস্টার্ন দুই বিভাগেই পারবর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর চলচ্চিত্রে সেই ছাপ স্পষ্ট। উষা উত্থুপ জানান, পার্ক স্ট্রিটের যে নাইটক্লাবে তিনি পারফর্ম করতেন, সেখানে প্রায়ই যেতেন সত্যজিৎ রায়। গানের প্রতি এহেন ভালবাসা এবং রায়ের এই প্রতিভা তাঁকে সহজেই সংগীতশিল্পী বা চিত্রশিল্প করে তুলতে পারত। কিন্তু সে সমস্ত কিছু ছেড়ে তিনি সিনেমা তৈরিতেই মন দেন। কারণ সিনেমা ছিল তাঁর প্রথম ভালবাসা।
যদিও সন্দেশ পত্রিকায় লেখালেখি দিয়ে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাবা সুকুমার রায়ের অকালমৃত্যুর পরেই যে পত্রিকা নুইয়ে পড়েছিল, সেই পত্রিকাকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন তিনি। এবং সফলও হয়েছিলেন। সন্দেশ পত্রিকায় তাঁর লেখার জনপ্রিয়তার পরেই, তিনি গল্পের বই লিখতে শুরু করেন। ফেলুদা থেকে শঙ্কু, মোল্লা নাসিরুদ্দিন থেকে তারিণী খুড়ো - তাঁর লেখা বইয়ে একের পর এক কাল্পনিক চরিত্র ফুটে উঠছিল, যা আজও বাঙালি থুড়ি গোটা বিশ্বের কাছে জীবন্ত।
সৌমিত্র রায়ের উল্লেখ না করলে সত্য়জিৎ সম্পর্কে যে কোনও আড্ডাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সত্যজিৎ রায়ের অত্যন্ত প্রিয় অভিনেতা ছিলেন সৌমিত্র রায়। প্রবাদপ্রতিম এই অভিনেতা গত বছরই সকলকে ছেড়ে চিরঘুমের দেশে হারিয়ে গিয়েছেন। তাঁর ভীষণ ইচ্ছা ছিল সত্যজিতের এই সেশনে অংশ নেওয়ার।
এর পাশাপাশি, সেশনে উপস্থিত প্রত্যেকেই মনে করালেন কী ভাবে এই মহামারী তাঁদের প্রিয়জনদের একের পর এক কেড়ে নিয়েছে। যে কারণে এক সঙ্গে কোনও অনুষ্ঠান করাও সম্ভবপর হচ্ছে না।
কথায়, গানে, আড্ডার প্রতি পরতে বার বার উঠে আসছিল সত্যজিৎ রায়ের কথা। কিন্তু সময়ের অভাবে বাকি থেকে গেলে অনেক অনেক গল্প। সেশনটি শেষ হল সত্যজিৎ রায়ের সেরা কাজগুলির একটি মন্তাজ দিয়ে।