জিতু-নবনীতা এবং তিয়াসা-সুবান।
নায়িকা বিবাহিত! তাতেই যেন খামতি। বছর দশেক আগে ছবিটা এমনই ছিল। বড় পর্দার মতোই ছোট পর্দার নায়িকাও অবিবাহিত থাকবে। অলিখিত শর্ত মেনে ‘ইষ্টিকুটুম’-এর রণিতা দাস, ‘বউ কথা কও’-এর মানালি মনীষা দে, ‘বিন্নি ধানের খই’-এর মনামী ঘোষ, ‘কেয়া পাতার নৌকো’-র ইপ্সিতা মুখোপাধ্যায় বা ‘রাশি’র গীত রায় ‘অবিবাহিত’ ছিলেন।
কিন্তু এখন হিসেব বদলেছে। তিয়াসার পাশে দর্শক সুবানকেই দেখতে চায়।
‘‘অসুবিধে কোথায়?’’ প্রশ্ন শুনে পাল্টা প্রশ্ন ‘কৃষ্ণকলি’র তিয়াসা রায়ের, ‘মহাপীঠ তারাপীঠ’-এর তারা মা নবনীতা দাসের। এঁরা ছোট পর্দার জনপ্রিয়, বাস্তবে বিবাহিত নায়িকা। তার পরেও তাঁদের ঘিরে অনুরাগীদের আকর্ষণ? তা হলে কি বিবাহিত মেয়েরাই টেলিপাড়ায় রাজ করছে?
তিয়াসার জবাব, ‘‘আগের কথা বলতে পারি না। তবে আমার ক্ষেত্রে দর্শক যেমন পর্দার ‘আমি’-কে নিয়ে আগ্রহী তেমনই বাস্তব জীবনে আমি কী করেছি সে বিষয়েও তাঁদের উৎসাহ আছে।” উদাহরণ দিয়ে আরও সহজবোধ্য করে দিলেন তিয়াসা, একটা সময়ের পর অভিনেত্রীদের পরিচয় তাঁদের অভিনীত চরিত্র। যেমন, শ্যামা যে শর্ট ড্রেস পরতে পারে, অন্যদের মতো চেঁচামেচি, হুল্লোড় করতে পারে সেটাই বিশ্বাস করতে চান না ‘কৃষ্ণকলি’র আর এক চরিত্র ‘রাধারানি’-র রিয়েল লাইফের মা! তিয়াসার পাশে সুবানকে দেখে দর্শকের কী প্রতিক্রিয়া হয়? “আমি যখন শ্যামার সাজে ছবি দিই তখন আমার পাশে নিখিলকে চায় সবাই, আবার আমি যখন তিয়াসা তখন আমার পাশে সুবান পারফেক্ট’’,জানালেন অভিনেত্রী। অর্থাৎ, বিবাহিত নায়িকাকে টেলিভিশনের পর্দা থেকে বাস্তবের মাটিতে দেখতে উৎসুক দর্শক।
দুই স্বামী মুখোমুখি হলে আরও মজা হয়, রসিকতায় সুরে ফাঁস তিয়াসার। বললেন, এক বার একটি অ্যাড শুটে তিনি গিয়েছিলেন সুবানের সঙ্গে। নিখিলও এসেছিলেন। “আমরা যখন শুট করলাম ওরা দু’জনে আড্ডা মারল। কাজ শেষ হতেই পার্টনার বদল!”
জিতের বিয়ের পর ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলাম
নবনীতা কিন্তু মেনে নিলেন, হিরো বা হিরোইনের বিয়ে হয়ে গেলে অনুরাগীরা দুঃখ পান। নিজের উদাহরণ টানলেন, ‘‘আমি তখন জিতের অন্ধ ভক্ত। ২০১০-এ যখন পছন্দের নায়কের বিয়ে হয়ে গেল তখন কী ভীষণ দুঃখ! এখন দেখি নায়ক-নায়িকার বিয়ে হলেও দর্শকদের কিচ্ছু আসে যায় না!’’পাশাপাশি এটাও স্বীকার করে নিলেন ‘তারা মা’, পুরোটাই নির্ভর করে অঞ্চল বিশেষের দর্শকের উপর। যেমন, শহরের দর্শক এ সব মাথাতেই আনে না। কিন্তু গ্রাম বা শহরতলির দর্শকের কাছে নায়িকা বিবাহিত হলে চাহিদা বা কদরে একটু হলেও টান ধরে। তবে অভিনয়ে জনপ্রিয়তা পেলে তারা ভুলেও যায় সব কিছু। যাঁরা স্বামী, পরিবারের সঙ্গে ছবি দেন সোশ্যালে, প্রথমবার তাঁদের দেখে ধাক্কা লাগে দর্শক মনে? ‘‘একেবারেই না। আমার আর জিতু কমলের কথাই ধরুন। যেই সোশ্যালে সবাই জানলেন আমরা স্বামী-স্ত্রী,অমনি আমাদের নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি হল। প্রচণ্ড সাপোর্ট পাই গ্রুপগুলো থেকে’’,পজিটিভ উত্তর মিলল নবনীতার থেকে।
সোনামণি কি সিঙ্গল?
অবিবাহিত হয়েও বিবাহিতের তকমা গায়ে
ছোট পর্দার এই মুহূর্তে ট্রেন্ডিং মোহর-শঙ্খ জুটি। একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত, নায়িকা সোনামণি সাহা বিবাহিত। তাঁর কাছে বিবাহিত মহিলা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি অবিবাহিত হয়েও বিবাহিতের তকমা গায়ে। কী বলি বলুন তো?’’ তারপরেই হাসতে হাসতে জানালেন কী ভাবে ছড়িয়েছে এই রটনা জানা নেই। কিন্তু এত বিশাল আকারে ছড়িয়েছে যে, তিনি এই ভুল ধারণা ভাঙাতে গিয়ে ক্লান্ত। তাই একটা সময়ের পরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সোনামণির সোশ্যাল যদিও বলে, তিনি অবিবাহিত, সিঙ্গল!
যদি সত্যিই সোনামণি বিবাহিত হতেন, শঙ্খ ওরফে প্রতীক সেনের সঙ্গে রোম্যান্টিক দৃশ্যে এত সাবলীল হতে পারতেন? সোশ্যাল পেজে তাঁদের নিয়ে এত গসিপ মেনে নিত শ্বশুরবাড়ি? এ বার অভিনেত্রী সিরিয়াস, ‘‘নিজেদের এবং দর্শকদের কাছে আমরা ‘চরিত্র’ মাত্র। ফ্লোরে যখন পা রাখি তখন আমি শুধুই মোহর। ঘর, পরিবারের কথা ভুলে যাই একেবারে। তাই, শুধুই রোম্যান্স নয়, কোনও দৃশ্যেই অসুবিধে হয় না।’’
প্রতিভাই সব, স্টেটাসে কি যায় আসে?
‘যমুনা ঢাকি’ শ্বেতা ভট্টাচার্যের কথায়: “কিছু দিন আগে পর্যন্তও বিবাহিত মেয়েরা অল্প সিঁদুর, নিদেনপক্ষে বাঁ হাতে নোয়া পরতেন। এখন এসবও নেই। ফলে, বোঝার উপায় নেই কে বিবাহিত, কার বিয়ে হয়নি। প্রযোজক, পরিচালকেরা দেখেন অভিনেত্রীর প্রতিভা। ওটা ঠিকঠাক থাকলে স্টেটাস কোনও ম্যাটারই নয়। আর দিনের শেষে দর্শক দেখে নায়িকার অভিনয়। চরিত্র ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারছেন কিনা। পারলে, তাঁকে মাথায় তুলবে। না পারলে মুছে দেবে। বিয়ে নিয়ে এত ভাবার সময় কোথায়?”
বিয়ে নিয়ে এত ভাবার সময় কোথায়?
কোনও কালেই বিয়ে নায়িকার ‘এক্স’ ফ্যাক্টর নয়
যদিও এই সমস্ত মানতে নারাজ চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মতে, “আজ কেন! কোনও দিনই ছোট পর্দার দর্শক এ সবে মাথা ঘামাননি। কারণ, তাঁরা অভিনেত্রীদের চেনেন ‘চরিত্র’ হিসেবে। চরিত্রের ভাল-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামান তাঁরা। অভিনেত্রীর ব্যক্তিজীবন নিয়ে নয়। ফলে, চিত্রনাট্যেও কোনও ছাপ পড়ে না।”
একই সুর প্রযোজক স্নিগ্ধা বসুর গলাতেও, ‘‘আমরা প্রতিভা দেখি। চরিত্রের উপযুক্ত যে অভিনেত্রী তাঁকে অফার দিই। তিনি বিবাহিত না অবিবাহিত, এ সব দেখার প্রয়োজনই বোধ করি না। সবাই সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতেই পারেন।’’ বিবাহিত নায়িকা পর্দায় রোম্যান্স করে বলে তার পরিবারে সমস্যা হতে পারে, কখনও মনে হয়েছে? ‘‘জোর গলায় বলতে পারি না যে হবে না’’, মত স্নিগ্ধার। তবে নায়িকা বিবাহিত হলে তিনি এই ধরনের সিন কতটা করতে পারবেন সেটা শুরুতে জানালে সুবিধে সবার পক্ষেই।
‘‘আমার স্ত্রী ক্যামেরার সামনে রোম্যান্স করেছেন, আমি টেক নিয়েছি! বিয়ের পরেও চুটিয়ে সব ধরনের চরিত্র করছেন। কোথাও কোনও সমস্যা হচ্ছে না তো?’’ ‘বিবাহিত’, ‘অবিবাহিত’ শব্দগুলোকে নস্যাৎ করতে গিয়ে অন্দরমহলের গল্প ফাঁস করে দিলেন প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার স্নেহাশিস চক্রবর্তী।
অস্বস্তি হয়নি আপনার, অভিনেত্রী স্ত্রী রূপসার? ‘‘একেবারেই না’’ গ্যারান্টি দিলেন। জোর গলায় এ-ও জানালেন, তাঁদের বন্ডিং এতটাই পোক্ত যে পর্দায় রোম্যান্সের পরেই হয়তো রূপসা ফোনে ছেলেকে শাসন করেন বা শাশুড়ির খবর নেন। ‘‘আজকের দিনে এ সব ভীষণ ‘কুল’’, মন্তব্য প্রযোজকের। সঙ্গে দাবি, শুধু রূপসা নন, অন্য বিবাহিত বা অবিবাহিত অভিনেত্রী এই ধরনের দৃশ্যে সাবলীল না হলে তিনি রীতিমতো ধমক দেন দৃশ্য ঠিকমতো ফুটিয়ে তোলার জন্য। উপযুক্ত মনে হলে অবিবাহিত চরিত্রের জন্য অবলীলায় বাছেন বিবাহিত অভিনেত্রীকে।
অর্থাৎ, যুগের দাবিতে বড় পর্দার অনুসরণকারী হয়ে উঠছে ছোট পর্দা। সেখানেও ইদানিং নায়ক-নায়িকা কনসেপ্টের বদলে জায়গা করে নিচ্ছে অভিনেতা-অভিনেত্রী শব্দগুলো। যাঁরা বাস্তব জীবনেবিবাহিত হোন বা অবিবাহিত, দর্শকের চোখে শুধুই ‘চরিত্র’।