ঋদ্ধি-ঋতব্রত
একজন পুরোপুরি গৃহবন্দি, অন্যজন আংশিক। প্রথমজন ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, যিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত। আর ঋদ্ধি সেনের বাবা-মা কোভিড পজ়িটিভ হওয়ায় বাড়ির সব দায়িত্ব আপাতত তাঁরই কাঁধে। অতিমারি তাঁদের থামিয়ে রাখতে পারেনি, বাড়িতে থেকেই সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দু’জনে। শুধু অতিমারি কেন, শাসকদলের রক্তচক্ষু থেকে ইন্ডাস্ট্রির বড় দাদা-দিদিদের নেতিবাচক মন্তব্য, কোনও কিছুই দমাতে পারে না দুই তরুণকে।
সম্প্রতি আলোড়ন তুলেছিল ‘নিজেদের মতো নিজেদের গান’, যার পরিচালনা ঋদ্ধি-ঋতব্রতর। সেই গান একাধিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ওই গানে যেমন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা, গায়ক, নাট্যকারেরা অংশ নিয়েছেন, তেমনই এই দুই বন্ধুও ছিলেন। যাঁরা সিনিয়র, তাঁরা জীবনে-সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে তুলনামূলক নতুন হয়ে গানের কথাগুলো বলার জোরটা ঋতব্রত বা ঋদ্ধি পেলেন কী ভাবে? (গানের কথা লিখেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য) বিশেষত যেখানে গানটিতে প্রত্যক্ষ ভাবে সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। ঋতব্রতর কথায়, ‘‘জোরটা আসে পরিবার থেকে। বাবা-মায়ের শিক্ষা থেকে। ছোট থেকেই শেখানো হয়েছে, সত্যি বলতে ভয় পাবি না।’’ কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমনই যে, রাজনৈতিক মতাদর্শে না মিললে, কাজ পেতে সমস্যা হতে পারে। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কী করবেন? ‘‘রাজনৈতিক মতাদর্শে মিল নেই বলে যদি কেউ কোনও কাজ থেকে বাদ দিতে চান, দেবেন। সেই কাজ আমি করতেও চাই না। অন্যায় মেনে নিয়ে মুখ বন্ধ করে থাকতে পারব না। আমি আরও অন্য অনেক কাজ পারি, একটা থেকে বাদ দিলে আর একটা বেছে নেব,’’ প্রত্যয়ী গলায় বললেন ঋতব্রত।
একই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ঋদ্ধির কাছেও। তাঁর জবাব, ‘‘বয়স কম, নতুন বলেই হয়তো ঝুঁকি নিতে পারি। সেটল করে গেলে অনেক সময়ে দায়বদ্ধতা এসে যায়। আর যে সত্যি বলতে চায়, সে যে কোনও বয়সেই বলতে পারে।’’ ঋদ্ধি মনে করিয়ে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস। ‘‘আমাদের এখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি, আন্দোলন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। লড়াই করার ক্ষমতা তো কম বয়সেই বেশি থাকে,’’ মত তাঁর। কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যায়নীতির সমালোচনার জন্য এখনও পর্যন্ত সমস্যায় পড়তে হয়নি ঋদ্ধিকে। বলছিলেন, ‘‘কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে কি না-র মতো প্রশ্নই বলে দিচ্ছে পরিস্থিতি কতটা খারাপ।’’
‘নিজেদের গান’-এর পাল্টা দু’টি গান বিজেপি শিবির থেকে প্রচারিত হয়েছে। সেই গানে রুদ্রনীল ঘোষ, বাবুল সুপ্রিয়, তনুশ্রী চক্রবর্তীদের দেখা গিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির বিজেপিপন্থী সিনিয়ররা ছেড়ে কথা বলেননি, ‘নিজেদের গান’-এর টিমের বিরুদ্ধে। তা নিয়ে খারাপ লাগা আছে? ‘‘না, এখন আর কোনও কিছুই অস্বাভাবিক লাগে না। দিলীপ ঘোষের ‘রগড়ে দেওয়া’ মন্তব্যকে যেমন রুদ্রদা (রুদ্রনীল ঘোষ) সমর্থন করেছেন দেখলাম। আবার বিজেপির রূপাঞ্জনাদি (মিত্র) বিরোধিতা করেছেন। তবে এটুকু বলতে পারি ‘রগড়ে দেওয়া’র কাজটা সহজ হবে না,’’ অকপট ঋতব্রত। ঋদ্ধির মতে, ইন্ডাস্ট্রি থেকে যাঁরা বিজেপি-তে গিয়েছেন, তাঁদের কোনও আদর্শ নেই। ‘‘আরএসস-এর মতাদর্শ আছে। এঁদের তো সেটাও নেই। আমাদের গানের যদি গঠনমূলক সমালোচনা করত, তা হলেও বুঝতাম। আর পাল্টা গান দুটো এতটাই হাস্যকর যে, বলার নয়,’’ বললেন তিনি। ‘নিজেদের গান’কে তাঁরা গণতন্ত্রর গান বললেও, বিজেপি শিবির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছে। ‘‘যেহেতু গানটায় সব্যসাচী চক্রবর্তী, চন্দন সেন রয়েছেন তাই সিপিএমের গান। আর রূপঙ্কর আছেন বলে, তৃণমূলের গান। এরা এটা ভাবতে পারে না যে, সত্যিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য দলের আশ্রয় নিতে হয় না,’’ মন্তব্য ঋদ্ধির।
কিছু দিন আগে ঋতব্রতর ‘দেশের নামে’ নাটকটির শো ছিল ত্রিপুরায়। সেখানে তাঁদের সোজাসুজি বলা হয়, ‘বিজেপি বিরোধী কথা বললে খবর হয়ে যাবে।’ তবে শো করতে পেরেছিলেন তাঁরা। ‘‘কনটেন্ট না জেনেই সবাই চড়াও হয়। নিজেদের ত্রুটি আছে বলেই ভাবে, সকলে আঙুল তুলছে,’’ মন্তব্য ঋতব্রতর। ‘দেশের নামে’-র টিমই কোভিড যুদ্ধে মানুষের পাশে রয়েছে। বাড়ি বসেই ফোন মারফত সব ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। বাবা কৌশিক সেন, মা রেশমির দেখভালের পাশপাশি ঋদ্ধিও যতটা পারছেন করছেন।
‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’— সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই ভাবনা হয়তো ঋদ্ধি বা ঋতব্রতর মতো তরুণদের মাধ্যমেই সত্যি হবে কোনও দিন!