শান্তিলালের প্রজাপতি রহস্যের কি সমাধান মিলল?
অভিনয়: পাওলি দাম, ঋত্বিক চক্রবর্তী, গৌতম ঘোষ প্রমুখ।
পরিচালনা: প্রতিম ডি গুপ্ত
ট্রেলার অনেক বেশি আশা দেখিয়েছিল, একটা টানটান রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা গপ্পের, এয়ারকন্ডিশনড হলে বসে যার জট ছাড়াতে বাঙালির মন্দ লাগবে না। তবে হলে গিয়ে দেখা গেল, জট ভাল রকম তৈরি হওয়ার আগেই ছেড়ে গিয়েছে। প্রতীম ডি গুপ্তর ‘শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য’ কিঞ্চিৎ রহস্য তৈরি করল বটে, তবে তার সমান্তরালে সমাধান সূত্রও দিয়ে দিল।
শান্তিলাল ‘দ্য সেন্টিনেল’ নামক সংবাদপত্রের ওয়েদার রিপোর্টার। চিরাচরিত মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিনিধি হিসাবে শান্তি আদর্শ! মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খায়, সকালে তাড়াহুড়ো করে কোনও রকমে অফিস যায়, নিজের ডেস্কে বসে মনে মনে ঈশ্বর-স্মরণ করে কাজে বসে, মুখ বুজে বসের রক্তচক্ষু সহ্য করলেও দিনের শেষে অফিস-তুতো দাদার কাছে দুঃখ করে বলে যে মিথ্যা রিপোর্ট লেখার এই নিত্যদিনের চাপ সে আর নিতে পারে না, তার বিবেকে লাগে। তার পর বাড়ি ফিরে আসে এবং এই রুটিনের জাঁতাকল চলে ৩৬৫ দিন। কখনও নিজের কাম-স্পৃহা নিবৃত্ত করার জন্য ডিভিডি চালিয়ে নিষিদ্ধ ছবি দেখে। কিন্তু এই অবসর অযাচিত ভাবে তাকে এনে দেয় তার কেরিয়ারের সবচেয়ে বড় স্টোরি, সে জড়িয়ে পড়ে এমন এক রহস্যে, যা উন্মোচন করতে গিয়ে সাংবাদিক শান্তি হয়ে ওঠে গোয়েন্দা শান্তি, এবং এখান থেকেই রহস্য শুরু।
প্রথম অর্ধ পর্যন্ত বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না কোনও বিষয়েই, ফলে অনেকটা ধোঁয়াশা নিয়েই অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় অর্ধের। ছবিটির অন্য কেন্দ্রে রয়েছে সিনেমা জগতের তারকা নন্দিতা, এবং তাকে ঘিরেই যাবতীয় রহস্য। তার অতীত জীবন নিয়ে এমন এক তথ্য জানতে পারে শান্তিলাল, যে সেই তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে সে পাড়ি দেয় চেন্নাই, তার পর সিঙ্গাপুর। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ সমেত এই স্টোরি এডিটরকে বেচে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড় বড় হেডিং সমেত তার বাইলাইনে লেখা বেরনোর স্বপ্ন দেখে শান্তি, যে আজীবন ওয়েদার রিপোর্ট লিখে গিয়েছে কোনও স্বীকৃতি ছাড়াই।
মূলত একটিই প্লট, একমুখী ভাবে ছবি এগিয়েছে। ছবির গল্প একমাত্রিক, অন্য কোনও সাব-প্লট তৈরির জায়গা দেওয়া হয়নি। সেটি কোনও ফাঁক বা সমস্যা সৃষ্টি করত না, যদি না সিনেমার চরিত্রগুলির কাহিনি আর একটু স্পষ্ট ভাবে ন্যারেটিভে আসত। মূল চরিত্র, অর্থাৎ যারা মূলত গল্পের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার সংখ্যা দুই। এক জনকে কেন্দ্র করে রহস্য আবর্তিত হয়েছে এবং আর এক জন তার উন্মোচন করেছে। প্রথম জন, অর্থাৎ নন্দিতার চরিত্র সম্পর্কে তা-ও দর্শক কিছুটা অবগত হয়, কারণ তার জীবনের গল্প অনুসন্ধানই গোয়েন্দা শান্তিলালের মুখ্য কাজ হয়ে ওঠে। তবে সেটাও ভীষণ ওপর-ওপর। একেই চরিত্রের সংখ্যা কম, উপরন্তু একটিই মাত্র ধারা গল্প এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে, ফলে অন্তত চরিত্রগুলির গঠন, তাদের আবেগ-মনস্তত্ত্ব-ব্যক্তিজীবনের জটিলতা আর একটু গভীরে গিয়ে ধরা খুব প্রয়োজনীয় ছিল। ফলত, বেশ কিছু অংশে ফাঁক রয়ে গিয়েছে, মনে হয়েছে যেন জোর করে রহস্য তৈরি করা হয়েছে। সিনেমার শেষে বড় বড় করে সবুজ টিকমার্ক-সহ ছবির টাইটেল ‘শান্তিলাল ও প্রজাপতি রহস্য’-র নীচে ‘সল্ভড’ লিখে দেওয়ার বেশ কিছু আগেই দর্শক সহজে আন্দাজ করতে পারবে শেষটা কী।
ছবিটির যাবতীয় রহস্যের কেন্দ্রে রয়েছে সিনেমা জগতের তারকা নন্দিতা।
এর সঙ্গে বেশ কিছু জিনিস ধন্দে রেখে দেয়। যেমন, সিনেমার শুরুর দিকের একটি দৃশ্যে শান্তিলালকে মহিলাদের টয়লেটে দেখা যায়, অথচ সেখানে এক জন পুরুষ কী ভাবে প্রবেশ করল তা বোঝা গেল না। আর একটি চরিত্র, রকেট রঞ্জন সহসা দেখা দেয় চেন্নাইয়ে, এবং শান্তিকে সে তার গন্তব্যে পৌঁছতে পথ বাতলে দেয় বিভিন্ন সময়। শান্তিও তার সাহায্যে (কী ভাবে তা জানা যায় না) খুব সহজেই পেয়ে যায় যা চায়। অথচ কেন সে উপস্থিত হয়, কেনই বা সাহায্য করে— কিছুরই উত্তর মেলে না, বরং মূল গতির সঙ্গে রকেট রঞ্জন ভীষণ বিচ্ছিন্ন ও অ-দরকারি ঠেকে।
তবে পরিচালককে কুর্নিশ অন্য কারণে— নন্দিতার চরিত্র। রসহ্যময়ী এই নারী অভিনয় জগৎ থেকে রাজনীতিতে পা রেখেছেন, এবং সাংবাদিক এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে তুলে ধরেন আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের যে কোনও সিদ্ধান্তকে অবিশ্বাসের চোখে দেখার প্রবণতা, কোনও কুণ্ঠা ছাড়াই। পুরুষ সাংবাদিককে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে এ-ও বলেন যে, এই সমাজের পুরুষেরা চায় না, ‘অব দ্য ওম্যান, ফর দ্য ওম্যান, বাই দ্য ওম্যান’, তাই এত পুরুষ অভিনয় করতে করতে রাজনীতিতে যুক্ত হলে এত প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু এই জায়গায় এক জন মহিলা থাকলেই চিত্রটা উল্টে যায়। অতীতে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসা নন্দিতা যেমন ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পুরনো দিনগুলো ভুলতে চায়, তেমনই আবার ধরেও রাখতে চায়। কারণ পুরনো দিনের নন্দিতাও তার অংশ, সে-ও নন্দিতা।
নন্দিতার একাকী জীবনের লড়াইয়ের গল্প, এক দীর্ঘ পথ পেরনো ক্লান্ত অথচ দৃপ্ত নারীর চরিত্র পাওলি দাম ফুটিয়ে তুলেছেন আবেগ দিয়ে, নন্দিতাকে তিনি জীবন্ত করতে পেরেছেন। পাশাপাশি শান্তিলালের চরিত্রে ঋত্বিকও প্রত্যাশিত ভাবে বেশ ভাল। এডিটর হিসাবে গৌতম ঘোষ তুখোড়, এবং রকেট রঞ্জনের ভূমিকায় অম্বরীশ যথাযথ। ছবিতে একটি ক্যামিও রোলে দেখা যায় পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়কেও।
ক্যামেরার কাজ ঝকঝকে, প্রশংসনীয়। বেশ কিছু দৃশ্যে রাতের কলকাতা, চেন্নাই, সিঙ্গাপুরের ব্যস্ত অলিগলি বা রাস্তার ছবি এত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে রাতের আলোকিত শহরই কখনও কখনও যেন একটা স্বতন্ত্র চরিত্র হয়ে উঠেছে। এই ফ্রেমগুলোর সঙ্গে আবহসঙ্গীত ও অর্কর সুরারোপিত গানগুলি মাননসই।
তবে, নিপাট একটা নতুন গোয়েন্দা গপ্পো দেখে আসার জন্য বাঙালি হলমুখী হতেই পারে।