সাদাকালো এই ছবি শুরু হতেই অনুষ্কা শঙ্করের সেতার নস্ট্যালজিয়ায় ধাক্কা দেয় সজোরে।
চরৈবেতি। অপুর জীবনকে এক কথায় বাঁধা যায় সম্ভবত এই শব্দটি দিয়েই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর সত্যজিৎ রায়ের অপুকে তাঁর ছবি ‘অভিযাত্রিক’-এ মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্র। ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের শেষাংশ অবলম্বনে তৈরি এ ছবি শুরু হচ্ছে অপু আর কাজলের কাশীযাত্রা দিয়ে। ছবিতে একে একে চলে আসে লীলা, বিমলেন্দু, রাণুদিদির মতো চরিত্ররা। অপুর দেখা হয় শঙ্করের সঙ্গে। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর। স্বপ্নদৃশ্যে আসে অপর্ণাও। ভ্রাম্যমান অপুর যাত্রাপথে একে একে এসে পড়ে কাশীর গলি, কলকাতার ভাড়া বাড়ি, নিশ্চিন্দিপুরের ভিটে।
সাদাকালো এই ছবি শুরু হতেই অনুষ্কা শঙ্করের সেতার নস্ট্যালজিয়ায় ধাক্কা দেয় সজোরে। পুরনোকে নতুন রূপে ফিরে পাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি, ভাল লাগার ওম রয়েছে, যা এ ছবি থেকে পাওয়া যায়। ছবির সম্বলও সেটাই। যার সামনে গল্প বলার ধরন ও নির্মাণের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতিও খানিক ফিকে হয়ে যায়। পর্দায় ভেসে ওঠা অসংখ্য ব্র্যাকেটে দেশ-বিদেশের পুরস্কারের উল্লেখ সেই ভাল লাগারই চিহ্ন বহন করে। এ ছবির আর এক শক্ত খুঁটি অপুর চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তী। দূরে নিবদ্ধ চাহনি আর কোমল শরীরী ভাষায় অপুকে জীবন্ত করে তুলেছেন অভিনেতা।
সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে লীলাকে প্রথমে আনবেন ভাবলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এ ছবির লীলা উঠে এসেছে উপন্যাসের পাতা থেকে। তবে এখানে তাঁর পরিণতি একটু অন্য ভাবে দেখানো হয়েছে। লীলার চরিত্রে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় ভাল লাগলেও অর্জুনের সঙ্গে তাঁর বয়সের পার্থক্য চোখে লেগেছে একটু।
ট্রেনযাত্রা শেষে কাজলের হাত ধরে অপু যখন কাশীর ঘাটে এসে দাঁড়ায়, পলকে মনে পড়ে যায় পাখির ঝাঁক আর তারসানাইয়ের ঝঙ্কার— হরিহরের মৃত্যুদৃশ্য। কাশীকে সত্যজিৎ রায় যত ভাবে দেখিয়েছেন, সুপ্রতিম ভোলের ক্যামেরায় তা ধরার চেষ্টা স্পষ্ট। প্রহরী আঁকা দরজা, গলি আটকে দাঁড়িয়ে থাকা ষাঁড়, মগনলালের মতো বজরা— সব উঁকি দেবে অপুর কাশীপর্বে।
শঙ্করের সঙ্গে অপুর দেখাও কাশীর ঘাটেই। অপুকে বেরিয়ে পড়ার মন্ত্র দেয় সে-ই। সব্যসাচী চক্রবর্তীকে দারুণ মানিয়েছে এই চরিত্রে। অপুর পাশে দাঁড়িয়ে যখন ইসলাম-বাইবেল-হিন্দু ধর্মের গোড়ার কথাটি মিলিয়ে দিচ্ছে শঙ্কর, অন্য মাত্রা পায় দৃশ্যটি।
কলকাতা-পর্বে আবার এসে পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনুষঙ্গ। দু’ভাগ হয়ে থাকা হাওড়া ব্রিজ নিয়ে যায় চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে। ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেবদাস’-এর পোস্টার, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বক্তৃতা, শহর জুড়ে ‘ফ্যান দাও’ রব, স্বদেশীদের পিকেটিং... সময়টাকে ধরার জন্যই যেন পরপর সব দেখিয়ে গিয়েছেন পরিচালক। এ সবের মাঝে অপু-কাজলের সংক্ষিপ্ত শহরবাস ততটা জমেনি। বরং গল্প যখন গিয়ে পড়ে নিশ্চিন্দিপুরে, হু-হু করে ফিরে আসে ‘পথের পাঁচালী’র স্মৃতি।
ভিটেয় ফিরে অপু দেখে, বাইরের দুনিয়া আমূল বদলে গেলেও বিশেষ বদলায়নি তার শৈশবের স্বর্গরাজ্য। শুধু এখনকার অপু-দুর্গারা এরোপ্লেন দেখে বিস্মিত হয়। প্রসন্ন মুদির মতোই কেউ শালপাতার ঠোঙায় মুড়ি এগিয়ে দেয় এখনও। সতু-রাণুদিদির বাড়িতে গিয়ে ওঠে অপু। রাণুর চরিত্রে শ্রীলেখা মিত্রের অভিনয় ভাল লাগলেও তাঁকে গ্রাম্য বধূ হিসেবে মেনে নেওয়া একটু মুশকিল। গ্রামের অন্যান্য চরিত্রের কাস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। অপর্ণা এ ছবিতে এসেছে অপুর একাকিত্বে, দোলাচলের মুহূর্তে। সংলাপহীন চরিত্রে দিতিপ্রিয়া রায়ের অভিনয় বাঙ্ময়। কাজলের চরিত্রে আয়ুষ্মান মুখোপাধ্যায় বেশ আদুরে।
ছবির গতি কিঞ্চিৎ শ্লথ। কাহিনি শেষ হয় পাহাড়ে, শঙ্করের হাত ধরে অপুর বেরিয়ে পড়ার দৃশ্যে। আগাগোড়া নস্ট্যালজিয়ায় মোড়া ‘অভিযাত্রিক’ নতুন করে অপুকে ফিরিয়ে দেয়। তার যাত্রাপথে শামিল হয়ে যায় দর্শকও। আবহে বিক্রম ঘোষ ছবির সনাতনী মেজাজ তৈরি করে দিয়েছেন। মহান স্রষ্টাদের বিশালত্বের কাছে এই ফিরিয়ে দেওয়াটুকুই ছবি থেকে প্রাপ্তি।