তিনি চেয়েছিলেন শ্রমকে গুরুত্ব দিতে, শ্রমের ধরনকে নয়। কেউ যদি ঝাড়ুদারের কাজ করেন, তাহলে যেন সেই কাজটাই এত নিখুঁত করে করেন যে ৫ জন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হন, কে পরিষ্কার করেছেন। মৃত্যুর এক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিজেও তাই করে গিয়েছেন। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হলেও কোনও কাজকেই ছোট, বড় কিংবা খারাপ হিসাবে দেখেননি। শুধু মাত্র তাঁর সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য সমস্ত সামাজিক ছুঁৎমার্গ ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।
সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে ৫০ বছর ধরে দেশবাসীকে বিনোদন দিয়ে গিয়েছেন তিনি। মরাঠি এবং হিন্দি ফিল্মের ‘মাদার’। সে সময় এ রকম সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে ফিল্মে যোগ দেওয়া তিনিই প্রথম মহিলা।
তখন ফিল্মে মহিলাদের কোনও জায়গা ছিল না। মহিলাদের চরিত্রেও কোনও পুরুষই অভিনয় করতেন সাধারণত। এমন সময়েই অসম্ভব সাহসী দুর্গা ইন্ডাস্ট্রিতে আসেন এবং নায়িকা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলেন। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আজ নায়িকাদের যে জায়গা এবং গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার সূচনা করে গিয়েছিলেন তিনিই।
২০০০ সালে ইন্ডিয়া টুডে প্রকাশিত ‘ভারতকে আকার দেওয়া ১০০ জন ব্যক্তি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দুর্গারও নাম প্রকাশিত হয়।
সমস্ত সামাজিক ছুৎমার্গ ভেঙে বেরিয়ে আসা দুর্গা ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত স্বনির্ভর। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি চাইলেই শ্বশুর-শাশুড়ির ছত্রছায়ায় অবিলম্বে এবং বিলাসবহুল ভাবেই নিজের সন্তানদের বড় করে তুলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সে দিক থেকেও মহিলাদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা।
তাঁর প্রকৃত নাম ভিটা ল্যাড। পরিবার গোয়ার বাসিন্দা। সেখান থেকে পরে মুম্বইয়ে চলে এসেছিল তাঁর পরিবার। ১৯০৫ সালে মু্ম্বইয়েই জন্ম তাঁর। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা দুর্গা উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় পড়াশোনা সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।
কলেজে পড়ার সময়ই বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বনাথ খোটের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পরও তিনি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু খুব অল্প দিনের মধ্যেই স্বামীর মৃত্যু হয়। তিনি তখন সবে ২৬ বছরে পা দিয়েছেন। মাথার উপর ছিল তাঁদের দুই সন্তানকে বড় করার চাপ।
দুর্গার স্বামীও বড় পরিবারের ছেলে ছিলেন। কিন্তু দুর্গা শ্বশুর বাড়ির উপর নির্ভরশীল হতে চাননি। নিজের দক্ষতায় চাকরির সন্ধান করতে শুরু করলেন।
ঠিক সে সময়ই এক বোন তাঁকে ফিল্মের কথা বলেন। প্রযোজক জেবিএইচ ওয়াদিয়ার বন্ধু ছিলেন তাঁর বোন। ওই প্রযোজক তখন ‘ফরেবি জাল’ নামে এক নির্বাক ফিল্ম করার কথা ভাবছিলেন। বোন সেই ফিল্মেই তাঁকে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রযোজক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দেন।
তখন কোনও বড় ঘরের মেয়েরা ফিল্মে আসার কথা ভাবতেই পারতেন না। এই পেশাক খারাপ চোখে দেখতেন সকলে। সে সমস্ত তোয়াক্কা না করে অভিনয় শুরু করে দিলেন দুর্গা।
১৯৩১ সালের এই নির্বাক ফিল্ম বক্স অফিসে একেবারেই হিট হয়নি। উপরন্তু প্রচুর সমালোচনা শুরু হয় দুর্গাকে ঘিরে। এমন বড় ঘরের মেয়ে দুর্গার অভিনয় করাটা দর্শক একেবারেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
কিন্তু দুর্গাও পিছু হঠার পাত্রী ছিলেন না। সমালোচনা বা বিতর্ক গায়ে মাখেননি একেবারেই। বরং নিজের শ্রম দিয়ে এই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জেদ চেপে যায় তাঁর। একই সঙ্গে দুর্গা চেয়েছিলেন মেয়েদের নিয়ে সমাজের এই ছুৎমার্গও ভেঙে ফেলতে।
এর পর বছরই ‘অযোধ্যা কা রাজা’ নামে আরও একটি মরাঠি ফিল্ম মুক্তি পায় তাঁর। ফিল্মে তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দর্শকদের ফিল্মটি দেখতে বাধ্য করেছিল। সে সময় দারুণ সফলও হয়েছিল ফিল্মটি।
এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ৫০ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারে তিনি ২০০টি ফিল্মে অভিনয় করেছেন। ঝুলিতে রয়েছে প্রচুর থিয়েটারও।
আরও একটি চিরাচরিত প্রথা ভেঙে ভেলেছিলেন তিনি। তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাইনে দেওয়ার চল ছিল। তাঁরা কোনও একটি ফিল্ম সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হতেন। সেই সংস্থার হয়ে ফিল্ম করতেন এবং মাসের শেষে নির্দিষ্ট টাকা বেতন পেতেন। অভিনেত্রী দুর্গা প্রথম এই বেতন নীতি ভেঙে বেরিয়ে আসেন।
কেরিয়ারের শুরুতে তিনি প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি আরও নানা সংস্থার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। এই ‘স্টুডিয়ো সিস্টেম’ ভেঙে তিনি প্রথম ফ্রিল্যান্স শিল্পী হয়ে ওঠেন এবং ফিল্ম পিছু পারিশ্রমিক নিজে ঠিক করতে শুরু করেন।
ইতিহাস তাঁকে আরও একটি কারণে মনে রেখেছে। সে সময় প্রথম হাতে গোনা কয়েক জন মহিলা ফিল্ম প্রযোজনা বা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দুর্গা। ১৯৩৭ সালে ফিল্ম ‘সাথী’-র প্রযোজনা এবং পরিচালনা দুটোই তিনি করেছিলেন।
১৯৩১ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। কেরিয়ারের শেষ ৩ বছর তিনি পুরোপুরি প্রযোজনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর সংস্থা প্রচুর শর্ট ফিল্ম, বিজ্ঞাপন এবং তথ্য চিত্র তৈরি করেছে।
একাই নিজের দুই সন্তানকে বড় করে তোলেন দুর্গা। ভাল স্কুলে পড়াশোনা করিয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠিতও করান। কিন্তু মাত্র ৪০ বছর বয়সে ছোট ছেলের মৃত্যু হয়। ছোট ছেলের মৃত্যুর পর অত্যন্ত ভেঙে পড়েন তিনি। তারপর থেকে কাজে আর ততটা মন দিতে পারেননি।
বাকি জীবন লেখালেখি করে কাটান। মরাঠিতে আত্মজীবনী লেখেন তিনি। ১৯৯১ সালে মুম্বইয়ে ৮৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও ইতিহাসের পাতায় তিনি আজও অমর হয়েই রয়ে গিয়েছেন।