ফিল্মে প্লেব্যাক করার ইচ্ছে সে ভাবে ছিল না কোনওদিন। কিন্তু জীবনের চিত্রনাট্য তাঁর জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল। তিনি হয়েই গেলেন বলিউডের গায়িকা। ইন্ডাস্ট্রিতে সে সময় লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের দাপট। কিন্তু অপূর্ব কণ্ঠস্বর আর প্রতিভার জোরে তিনিও নিজের জায়গা করে নিলেন। তবে যতটা স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল, ততটা পাননি বলেই মনে করেন অনেকে। তিনি, শিল্পী সুমন কল্যাণপুর।
সুমনের বাবা শঙ্কর রাও হেমাডি ছিলেন আদতে কর্নাটকের মেঙ্গালুরুর সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। অবিভক্ত ভারতে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ আধিকারিক শঙ্কর দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে ছিলেন ঢাকায়। সেখানেই ১৯৩৭ সালের ২৮ জানুয়ারি জন্ম সুমনের। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবথেকে বড়। ১৯৪৩ সালে শঙ্কর হেমাডি ও তাঁর স্ত্রী সীতা চলে আসেন তৎকালীন বম্বে শহরে। সেখানেই বেড়ে ওঠা সুমনের।
গায়িকা হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। বরং, ছোটবেলায় ভাল লাগত ছবি আঁকতে, সেলাই করতে আর বাগানের যত্ন নিতে। আঁকার শখ বজায় ছিল জীবনের পরবর্তী পর্বেও। সেই শখের জন্যই সাবেক বম্বের সেন্ট কোলাম্বা স্কুলের পরে সুমন ভর্তি হন স্যর জেজে স্কুল অব আর্টস-এ।
কৈশোরে ভাল লাগতে শুরু করে নূরজাহানের গান। স্কুলে বা বাড়ির অনুষ্ঠানে গান গাইতেন সুমন। সেরকমই এক অনুষ্ঠানে তাঁর গান শোনেন প্রখ্যাত মরাঠি সঙ্গীত পরিচালক কেশবরাও ভোলে। তিনি কথা বলেন সুমনের বাবা-মায়ের সঙ্গে। মেয়ের প্রতিভাকে নষ্ট না করার অনুরোধ করেন। নিজেই সুমনকে তালিম দিতে শুরু করেন তিনি।
কেশবরাও বুঝেছিলেন সুমনের গলা লাইট মিউজিকের জন্য আদর্শ। তাঁর পরামর্শেই লাইট মিউজিকে মনোনিবেশ করেন সুমন। কেশবরাওয়ের উদ্যোগে ১৯৫৩ সালে প্রথম রেডিয়োতে গান সুমনের।
কেশবরাওয়ের পাশাপাশি উস্তাদ খান, আব্দুল রহমান খান, গুরুজি মাস্টার নবরং খানের কাছে তালিম নেন সুমন। এর মাঝেই প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ। ১৯৫৩ সালে, মরাঠি ছবি ‘শুকরচি চাঁদনি’-তে গান করেন সুমন। স্কুলের এক অনুষ্ঠানে সপ্তদশী সুমনের গান শুনে মুগ্ধ হন শিল্পী তালাত মামুদ ও সঙ্গীত পরিচালক মহম্মদ শফি।
মহম্মদ শফি তাঁর ‘মঙ্গু’ ছবিতে সুযোগ দেন সুমনকে। কথা ছিল, তিনটি গান গাইবেন সুমন। কিন্তু শেষ অবধি কোনও অজ্ঞাত কারণে শফির জায়গায় সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান ওপি নাইয়ার। তিনটির বদলে একটি গানের সুযোগ পান সুমন। ১৯৫৪ সালে, ‘মঙ্গু’ ছবি দিয়েই হিন্দি ছবিতে প্রথম প্লে ব্যাক সুমনের।
সে বছরেই ‘দরওয়াজা’ ছবিতে সুমনের সঙ্গে প্লেব্যাক করেন তালাত মামুদ। তালাত মামুদ তাঁর সঙ্গে ডুয়েট করতে রাজি হওয়ায় ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিত হতে সাহায্য করে সুমনকে। পাঁচ থেকে সাতের দশক অবধি হিন্দি ছবিতে সুমন একের পর এক সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন।
‘বাত এক রাত কি’, ‘দিল এক মন্দির’, ‘নুরজাহান’, ‘দিল হি তো হ্যায়’, ‘জাহান আরা’, ‘পাকিজা— লম্বা হতে থাকে সুমনের সাফল্যের তালিকা। শঙ্কর জয়কিষণ, রোশন, মদনমোহন, শচীনদেব বর্মন, নৌশাদ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সমকালীন সব নামী সঙ্গীত পরিচালকের নির্দেশনায় কাজ করেছেন তিনি।
মনোমালিন্যের জেরে মহম্মদ রফি ও লতা মঙ্গেশকর বেশ কিছুদিন ডুয়েট করেননি। সে সময়ে রফি ও সুমন কল্যাণপুর প্রায় ১৪০ টি ডুয়েট করেন। তাঁদের ডুয়েটের মধ্যে ‘আজকাল তেরে মেরে প্যায়ার কে চর্চে’, ‘না না কর কে প্যায়ার’-এর মতো চিরসবুজ গান অসংখ্য। পাশাপাশি তিনি ডুয়েট করেছেন মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও।
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সুমনের কণ্ঠ ও গায়কির আশ্চর্য সাদৃশ্য। অনেক সময়েই এরকম হয়েছে, সুমনের গান পরিচিত হয়েছে লতার গান বলে। সুমন জানিয়েছিলেন, কিংবদন্তিসম শিল্পী লতা তাঁর প্রিয় শিল্পী। কিন্তু তিনি কোনওদিন তাঁকে ইচ্ছাকৃত ভাবে অনুকরণ করেননি।
শোনা যায়, অনেক সময়েই লতা কোনও গান গাইতে রাজি না হলে সে গান যেত সুমনের কাছে। প্রযোজকের বাজেট কম থাকলেও বেছে নেওয়া হত সুমনের কণ্ঠকেই। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, এই সাদৃশ্যই সুমনের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা তৈরি করেছে। প্রতিভার উপযুক্ত স্বীকৃতি তিনি পাননি। হেমন্ত মুখোপাধ্যারে নির্দেশনায় ‘কভি আজ কভি কাল’ গানটিতে ডুয়েট করেন লতা মঙ্গেশকর ও সুমন কল্যাণপুর।
কেরিয়ারের পাশাপাশি সংসারও সমান গুরুত্ব পেয়েছে সুমনের কাছে। ১৯৫৮ সালে তিনি বিয়ে করেন মুম্বইয়ের ব্যবসায়ী রামানন্দ কল্যাণপুরকে। রক্ষণশীল পরিবার হলেও বিয়ের পরে সুমনের ছবিতে গান গাওয়া বন্ধ হয়নি। তাঁর সঙ্গে রেকর্ডিংয়ে যেতেন তাঁর স্বামী রামানন্দ। তাঁদের একমাত্র মেয়ে চারুলা বিয়ের পরে আমেরিকা-প্রবাসী।
ছায়াছবির বাইরেও গান করেছেন সুমন। হিন্দি, মরাঠির বাইরে বাংলা, অসমিয়া, গুজরাতি, কন্নড়, ভোজপুরি, ওড়িয়া, মৈথিলী ও পঞ্জাবি ভাষাতেও জনপ্রিয় গান আছে তাঁর। সুমনের কণ্ঠে বাংলায় গাওয়া ‘মনে কর আমি নেই’ ‘আমার স্বপ্ন দেখা’র মতো বহু গানই আজও অমলিন।
সুমন কল্যাণপুরের ধ্রুপদী গানের রেকর্ড বিরল। কিন্তু ধ্রুপদী গানেও তাঁর ছিল অনায়াস বিচরণ। হিন্দি ছবিত রাগাশ্রয়ী গানের জন্য তিনি তিন বার ভূষিত হন ‘সুর শ্রীনগর সংসদ’ সম্মানে। ২০০৯ সালে মহারাষ্ট্র সরকার তাঁকে সম্মানিত করে ‘লতা মঙ্গেশকর পুরস্কারে’।
ভারতের বাইরে বিদেশেও সমাদৃত সুমন কল্যাণপুরের মধুকণ্ঠ। বড়ে গোলাম আলির ভক্ত এই শিল্পী এখন অশীতিপর বৃদ্ধা। সুরের সাধনা তাঁর কাছে উপাসনার সমতুল্য। সঙ্গীত থেকে জীবনে কী পেয়েছেন, কী পাননি, তা নিয়ে বিশেষ বিচলিত নন। আক্ষেপও নেই। যা পেয়েছেন, তাই নিয়েই তৃপ্ত এই প্রতিভাময়ী। (ছবি : সোশ্যাল মিডিয়া)