বিয়ের পর একাই উইকএন্ডে প্যারিস ঘুরতে যাচ্ছে শ্রীতমা। হবু বর সৈকতের পিএইচডি এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু বিয়েটা হয়ে গেছে ওদের। শ্রীতমাকেও পোস্ট ডক-এর জন্য ফিরে যেতে হচ্ছে জার্মানি। উইকএন্ডে একাই বেরিয়ে পড়েছে প্যারিসে। না, এটা ‘কুইন’-এর সেই রানির গল্প নয়। বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় যে-রানিকে একা হনিমুনে যেতে হয়েছিল। অবশ্য একা না গেলে রানির তো যাওয়াটাই হত না। বিয়েটা টিকল না। কিন্তু স্বপ্নটা বেঁচে গেল। আসলে খুশি থাকার জন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হয় না। কেকের ওপর মোমবাতি জ্বালিয়ে সেটা একাও কাটা যায়।
তেইশ বছরে কেরলে একা বেড়াতে গিয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী। মাল্টিন্যাশনাল ব্যাঙ্কের এই কর্মী বললেন, ‘‘বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া তো হলই। আর আমার অতি আধুনিক বন্ধুরাও বলে বসল, একা যেতে গেলে অনেক সাহস লাগে। কী সাহস আমার।’’ বছর তিরিশের পূর্বাশার গলাতেও একই রকম বিস্ময়। বললেন,
‘‘রোজ ফেসবুক খুলে দেখতাম বন্ধুরা বেড়ানোর ছবি আপলোড করছে। আমি যাদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে চাইছি, হয় তাদের সময় হচ্ছে না, নয় বাজেট ক্লিক করছে না। তখন নিজেই বেরিয়ে পড়লাম। আর সেই যে বেরোলাম, অভ্যেসটা রয়ে গেল। বছরে একবার নিজেকে ডিটক্স করতে একা বেড়াতে যাবই।’’
নিজের আইফোনেই টিকিট কাটা থেকে হোটেল বুকিং সবইসেরে ফেলছে আজকের মেয়েরা। সম্প্রতি বাবাকে আইফোনও কিনে দিয়েছেন প্রিয়দর্শিনী। আইফোনে ‘ফাইন্ড মাই ফ্রেন্ড’ অ্যাপের সাহায্যে প্রিয়দর্শিনীর বাবা-মা জেনে যান মেয়ে কোথায় কখন যাচ্ছেন। বাবা-মা’দের দুশ্চিন্তাও এখন দূর।
সমীক্ষা বলছে মেয়েদের একা বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা গত দু’বছরে চল্লিশ শতাংশ বেড়েছে। এখন মেয়েরা স্বনির্ভর জীবন যাপনে অভ্যস্ত। এই স্বনির্ভরতা শুধু মাত্র আর্থিক স্বনির্ভরতা নয়। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ মেয়েরা একা একা উপভোগ করতে চাইছে। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মেয়েদের এই একা বেড়াতে যাওয়া আসলে একটা হিউম্যান ইচ্ছের প্রকাশ। পুরুষরাই শুধু ভবঘুরে হবে এমনটা নয়। যা খুশি তাই করার আনন্দ, অবসর যাপন, মানসিক অবসাদ এ সবের মধ্যে বন্দি মেয়েদের মন। নিজেদের ভেতরটাকে জানতে চাওয়ার তাগিদ থেকে বেড়াবার ইচ্ছেটা জাগছে।’’
কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই কি হুটহাট বেরিয়ে যাওয়া যায়? ইন্টারনেটে রয়েছে মেয়েদের বেড়াতে যাওয়ার অজস্র ওয়েবসাইট। আছে ‘ওয়ান্ডার লাস্ট’য়ের মতো ট্র্যাভেল ক্লাব। অজস্র নারী পর্যটকের ব্লগ। কোথায় কী ভাবে বেড়াতে যাবেন, কী সঙ্গে নেবেন, তার সব হালহদিশই দেওয়া আছে সেখানেই। কয়েক বছর ধরে মহিলাদের বেড়াবার আয়োজন করে এমন এক সংস্থার কর্ণধার মিমি চক্রবর্তী বললেন, ‘‘নিছক বেড়াতে যাওয়াই নয়, আজকের মেয়েরা বেড়াতে গিয়ে চাইছে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ। আমাদের প্রত্যেকটা প্যাকেজেই তাই ট্রেকিং, র্যাফটিং, ডাইভিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। অন্য এক নারী ভ্রমণ সংস্থার কর্ণধার অনিতা অগ্নিহোত্রী অবশ্য বললেন, ‘‘নারী ভ্রমণকারীদের টানতে আমরা ফেসবুকে আপডেট দিতে থাকি। জানাতে থাকি শ্রীলঙ্কায় স্ট্রিট শপিংটা কতটা সস্তা হল। বা রাজস্থানে পুষ্কর ফেস্টিভ্যালে এ বার মূল আকর্ষণ কী।’’
অ্যাপ-এ ঘুরুন
• হিপমাঙ্ক: অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস অ্যাপ। বেড়াতে যাওয়ার জায়গা থেকে হোটেল বুকিং— সব কিছুই আপনার হয়ে করে দেবে হিপমাঙ্ক। বেড়ানোর ঠিক শেষ মুহূর্তে সবচেয়ে সস্তায় কোন হোটেলে থাকবেন তার সন্ধান ও বুকিংও করে দেবে এই অ্যাপ। এখানে পড়তে পারেন ট্রিপ অ্যাডভাইজারের রিভিউ-ও
• ট্রিপইট: একা ট্রাভেল করছেন। নিরাপত্তাটাও তো দরকার। আপনি যে হোটেলে থাকবেন, আপনার ফ্লাইট টাইমিং, কোন হোটেল থেকে কখন বেরোচ্ছেন, সেই সব তথ্যই ট্রিপইট একটা তালিকা বানিয়ে শেয়ার করে দেয় আপনার বন্ধু বা পরিজনদের মধ্যে
• হোটেল টুনাইট: হুটহাট বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে? আজ রাতেই? বা ফ্লাইট বাতিল হয়েছে? চোখ বুজে ভরসা রাখুন হোটেল টুনাইট-এর ওপর! আপনার জন্য নিরাপদ জায়গায় বুক করে দেবে বেস্ট ডিল-এর হোটেল
• ট্যাক্সি ফর শিওর: কোথায় বেড়াবেন? গাড়ি বুক হয়েছে তো? না থাকলেই বা কী! আছে ট্যাক্সি ফর শিওর। ধরুন সিমলা থেকে দিল্লি যাচ্ছেন। এই ট্যাক্সি ফেরার ভাড়াটা নেবে না আপনার থেকে। নিশ্চিন্ত থাকুন
• গ্যাসবাডি: গাড়ি চালিয়ে হুট করে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়া আপনার নেশা? চিন্তা কী? গ্যাস বাডি আছে তো। আপনার ড্রাইভিং ট্র্যাক-এ কোথায় সবচেয়ে সস্তায় রিফুয়েল করতে পারবেন সেই তথ্য আপনাকে দিয়ে দেবে এই অ্যাপ
শুধু মাত্র অ্যাডভেঞ্চারই নয়, খাওয়াদাওয়া থেকে টেন্টে রাত কাটানোর জমজমাট আয়োজনে ভেসে যাচ্ছেন মেয়েরা। শুধু নতুন প্রজন্ম নয়, একা বেড়ানোর এই নেশায় মাতছেন চল্লিশোর্ধ্ব মহিলারাও। বরেদের সময় না হওয়ায় হঠাৎ একদিন এক দল চল্লিশোর্ধ্ব অধ্যাপিকা গাড়ি নিয়ে সোনাঝুরি চলে গিয়েছিলেন। তার পর থেকে এই মহিলাদের দলের ভ্রমণটা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে তাঁরা এই বছর ব্যাঙ্কক- পাটায়া যাওয়ারও পরিকল্পনা করছেন।
‘‘এখন মহিলারা নিরাপদে বেড়াতে যেতে পারেন। এখন তো অ্যাপেই মহিলা ট্যাক্সি ড্রাইভার পাওয়া যায়। আর আমার মেয়ে ট্র্যাভেল অ্যাপ দিয়ে আমাদের সব বুকিংও করে দেয়,’’ বললেন সেই দলেরই অধ্যাপিকা সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে সবটাই এত সহজ নয়। সদ্যই দেবত্রী ঘোষ একা বেড়াতে গিয়ে হোটেলে সিকিওরিটির আচরণে অস্বস্তি বোধ করেছেন। একা পেয়ে অরাত্রিকা ঘোষকে অনুসরণ করেছিল দিল্লির ট্যাক্সিচালক।
ঘুরুন একাই। কিন্তু চোখ কান যেন খোলা থাকে।