অশোক স্তম্ভ বিতর্কে মুখ খুললেন কৌশিক সেন
সঙ্গত বা অসঙ্গত কি না, সেই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে এ বিষয়টা। বিজেপি এবং আরএসএস মিলে এই সরকারের আসল চেহারাটা বার করে আনছে। তাদের উদ্দেশ্যটা বেরিয়ে আসছে। অনুপম খেরের একটি মন্তব্য দেখলাম, যেখানে তিনি বলেছেন, এটা নতুন ভারতবর্ষের চেহারা। বলেছেন, সিংহের যদি দাঁত থাকে সেটা সে দেখাবে। প্রয়োজন হলে সিংহ কামড়াবেও।
একটা সময় ছিল যখন বিজেপিরও একটা রাখঢাক ছিল। আজ নূপুর শর্মা হোক বা অনুপম খের, তাঁরা যে এ ভাবে দৃঢ় স্বর তুলতে পারছেন, তার কারণ একটাই। ২০২৪-এর লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসবে, বিজেপি এবং আরএসএসকে তাদের নগ্ন চেহারাটা যে বার করতেই হবে! সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ীই গত দু-তিন বছরে দেশে বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি সবই প্রায় রেকর্ড ছুঁয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারীর সংখ্যাও আরও বেড়েছে। এগুলো থেকে যদি মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে হয়, তবে দুটো জিনিসের প্রয়োজন । এক, হিংস্র চেহারাটাকে বার করা। এবং সেই চেহারার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া জীবনের যাবতীয় অশান্তির মূল কারণ কারা। ওরা বোঝাতে চাইবে, সব কিছুই হচ্ছে ধর্মীয় ভেদাভেদের কারণে। কখনও কখনও সঙ্গে বিদেশি শক্তির ভয় দেখানো হবে। কখনও দেশের ভিতরে কিছু শত্রু তৈরি করা হবে। সেটা কখনও বুদ্ধিজীবীদের, কখনও শিল্পীদের। তাঁদের মাওবাদী বলে কিংবা তাঁদের বিদেশি শক্তির চর হিসেবে দেগে দেওয়া হবে। যেমন, মেধা পটেকর থেকে শুরু করে তিস্তা শেতলবাদ পুরো সিভিল সোসাইটিটাকে ধ্বংস করা হবে। বলা হবে দাঁত-নখ না দেখালে তাঁদের সামলানো যাবে না। এবং সংখ্যালঘুদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বলার চেষ্টা চলবে যে এঁদের জন্যই আমজনতা বঞ্চিত হচ্ছে। এবং এর থেকে তাঁদের বিজেপি, আরএসএস-ই বার করবে। সে জন্যই সিংহের চেহারাটা বদলানো হয়েছে।
এখন আর এটাকে আড়াল করার কোনও প্রচেষ্টা বিজেপির নেই। যত দিন যাবে, ২০২৪ যত এগিয়ে আসবে, এ রকম আরও অনেক ঘটনা ঘটতে থাকবে। এগুলো ইচ্ছে করে, পরিকল্পিত ভাবে করা হচ্ছে। অমিত শাহের সরকার রূপকথাগুলোকেও এখন ইতিহাস বলে চালাতে চাইছে। ইতিহাস বদলানোর সংকল্প করেছে তারা।
বাঙালিদের মধ্যে একটা বড় অংশের মুসলিম বিদ্বেষ রয়েছে, যেটা বিধানসভা ভোটের সময়ে সে ভাবে বেরোয়নি। এটা তাতে ইন্ধন জোগাবে। তবে বিজেপি যেটা সফল ভাবে পেরেছে, সেটা হল উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে। ৫৬ ইঞ্চি ছাতির নরেন্দ্র মোদীকে হিরো হিসেবে ভাবতেই ভাল লাগে তাঁদের। এই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোই তাঁদের পক্ষে আদর্শ।
কেন বেকারত্ব এই জায়গায়, কেন বাজারে গেলে হাত পুড়ে যাচ্ছে, কেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভাতা পাচ্ছেন না এগুলো নিয়ে মানুষের কোনও প্রশ্ন নেই। কোনও আন্দোলন নেই সমাজে। বরং বিতর্কটাকে ওরা ওই দিকে নিয়ে যাবে। সিংহের দাঁত কতটা বড় হওয়া দরকার, আর কতটা নয়।
কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও, যাঁরা চুপ রয়েছেন, তাঁদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। একটা বড় অংশ রয়েছে, যারা বলতে ভয় পায়। তবে মনে মনে একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থনও রয়েছে তাদের। তাঁরাই বলছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এই সিংহটা ঠিক আছে।
আমাদের দেশে ক্রিকেটার এবং অভিনেতাদের জনপ্রিয়তা বিশাল। তাঁরা কিছু বললে মানুষ শুনবে। কিন্তু দেশের কোনও বিষয় নিয়ে তাঁরা কোনও কথা বলেন না। বলতে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখেছি শাহরুখ খানের অবস্থা। মাদক কাণ্ডে তাঁর ছেলেকে ফাঁসিয়ে পরিবারের সঙ্গে যা করা হল! আমিরও দু'এক বার বলতে গেলেন, তাঁকেও চুপ করিয়ে দেওয়া হল।
বিপরীতে আমরা আমেরিকান শিল্পীদের দেখতে পাই। রবার্ট ডি নিরো থেকে শুরু করে মেরিল স্ট্রিপ তাঁরা অস্কার মঞ্চে দাঁড়িয়েও সরকারি নিয়মনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভয় পান না। কিন্তু ভারতে এটা সম্ভবই নয়। কাজেই সরকারেরও ওই দিক থেকে চাপ নেই। এখানে চাপটা এসে পড়ে মেধা পটেকর, তিস্তা শেতলবাদের মতো মানুষদের থেকে, যাঁরা প্রতিদিনের লড়াইটা করেন।