পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: বিনোদন দুনিয়ায় ২০ বছর পার, একাধারে অভিনেতা-প্রযোজক-পরিচালক আপনি। যাত্রাপথ কতটা উপভোগ্য?
পরমব্রত: আলাদা করে এ সব নিয়ে ভাবি না। আমি তো আর কিছুই করতে পারি না। সিনেমা ছাড়া। সেটাই যত ভাবে করতে পারি করার চেষ্টা করে চলেছি। আমার মতো করে। চলতে চলতে উত্থান-পতন অনেক কিছুই ঘটেছে। ছোট পর্দা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার পর ছবি করতে শুরু করি। মাঝে পড়াশোনা করতে চলে যাই। ফিরে এসে অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা। সব ধারাতেই কাজ করছি। আগামী দিনেও করব। এই পর্যন্ত।
প্রশ্ন: মা সুনেত্রা ঘটক, বাবা সতীনাথ চট্টোপাধ্যায় আপনার এই সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। মিস করেন ওঁদের?
পরমব্রত: আমি সফল কিনা সত্যিই জানি না। তবে মা বাবার তুলনায় আমার অনেক কাজই দেখে গিয়েছেন। সেটুকুই স্বান্তনা। বরং বাবা কিছুই দেখে যেতে পারেননি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ছবি ‘আজব কারখানা’ আর আপনার ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ কি সমসাময়িক?
পরমব্রত: দুটো ছবির নাম কেন এক সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে! বুঝতে পারছি না। আমি একটু পরিষ্কার করে দিই। ‘ট্যাংরা ব্লুজ’-এ কিন্তু আমি রক স্টার নই। যেটি বাংলাদেশের শবনম ফিরদৌসি বানিয়েছেন। ট্যাংরার বস্তির এক দল বাচ্চাকে নিয়ে সঞ্জয় মণ্ডল একটি গানের দল বা ব্যান্ড বানিয়েছিলেন। তাই নিয়ে প্রথম ছবিটি। পরের ছবিটি বাংলাদেশের এক রক স্টারকে নিয়ে। যিনি ছোট পর্দার একটি গানের শো সঞ্চালনা করতে গিয়ে লোক গান-সহ নানা ধারার গানে সমৃদ্ধ হবেন। মঞ্চে গিটার হাতে দল নিয়ে গান গাইলেই কিন্তু সেটা রক গান নয়। রক মিউজিকের নিজস্ব দর্শন আছে। গান-বাজনারও আলাদা শৈলী রয়েছে।
প্রশ্ন: আজব কারখানার রক স্টার হয়ে উঠতে কী ভাবে প্রস্তুতি নিলেন?
পরমব্রত: বাংলাদেশিরা রক গানকে ভীষণ গুরুত্ব দেন। বহু বছর ধরেই। রক স্টার বা গায়ক, তাঁদের গানের ভাষা, তাঁদের জীবনের একটি বিশেষ ধারা রয়েছে। তার মানে সবারই যে লম্বা চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ থাকবে তেমনও নয়। পাশ্চাত্যের বহু রক শিল্পীর কিন্তু বড় চুল, দাড়ি-গোঁফ নেই। তবু রক স্টার বললেই যে রকম চেহারা চোখে ভাসে সেটাই ধরার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। আমিও যতটা পেরেছি তার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। ওই দেশের রক স্টারেরা সাধারণত চামড়ার জ্যাকেট পরেন। আমাকেও সেই পোশাক পরতে দেখা যাবে। এ ছাড়া, বিশেষ গানের শিল্পীরা তারকা হওয়ার পরে বিলাসী জীবন কাটান। বহু অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে ভালবাসেন। তাঁদের আচরণও একটু অন্য হয়। বাংলাদেশ এবং পাশ্চাত্যের নামী শিল্পীদের দেখে সেগুলো অনুকরণেরও চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া, বাংলাদেশের রক মিউজিক সম্পর্কে আগে থেকেই আমার বেশ কিছুটা পড়াশোনা ছিল। যা রক স্টারের ভূমিকায় অভিনয় করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে।
আজব কারখানায় পরমব্রত।
প্রশ্ন: পোস্টারে আপনার লম্বা চুল। স্বাভাবিকত্ব আনতে চুল বড় করেছিলেন?
পরমব্রত: (অল্প হাসি) পুরোটাই নকল। চেষ্টা করলেও আমার চুল অত বড় হবেই না! দুটো ভিন্ন রূপ দেখা যাবে ছবিতে। সেই অনুযায়ী দু’ধরনের পরচুলা তৈরি হয়েছিল আমার জন্য।
প্রশ্ন: সম্প্রতি রূপম ইসলাম ‘অ-জানাকথা’য় অনুযোগ জানিয়েছেন, রক গান এখনও যথার্থ মর্যাদা পায়নি। দুই দেশের তুল্যমূল্য বিচারে আপনারও কি তাই মত?
পরমব্রত: কী করে পাবে বলুন? আমরা যত দিন না বুঝব যে কিছু লোক মঞ্চে উঠে গিটার হাতে গান গাইছেন মানেই সেটা রক মিউজিক নয়, তত দিন পর্যন্ত সেই মান্যতা আশা করাই বৃথা। ব্যান্ডের আলাদা দর্শন। রক মিউজিকের আলাদা। সেটাও বুঝতে হবে। রূপম খুব ভুল বলেননি। রকের দর্শন কিন্তু পাব ব্যান্ড, জাজ ব্যান্ড, র্যাপ ব্যান্ড, অল্টারনেটিভ ব্যান্ডের থেকে অনেকটা আলাদা। সেটা বুঝলে তবে রক মিউজিক তার যোগ্য মর্যাদা পাবে।
প্রশ্ন: ২০ বছরে বাংলা ছবির অনেক বিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশেও কি তাইই হয়েছে?
পরমব্রত: ২০১৫ থেকে বাংলাদেশের ছবি করছি। হ্যাঁ, ওখানেও অনেক বদল এসেছে। আমরা এ পার বাংলায় বসে ওঁদের অনেক কাজ নিয়েই হয়তো উন্নাসিকতা দেখাই। ওঁদের ১০টা কাজের মধ্যে সাতটি কাজ হয়ও হয়তো খুবই তাড়াহুড়োয় বানানো। ছোট পর্দার জন্য এক সঙ্গে অনেক কিছু বানানোর চেষ্টা করেন বলে এমন হয়। বাকি তিনটি কিন্তু খুবই উচ্চ মানের। সে গুলো আন্তর্জাতিক মানের। বাংলাদেশের বেশ কিছু সিরিজ আমাদের দেশে জনপ্রিয় সেই কারণেই।
প্রশ্ন: ভারতীয় মহিলা পরিচালকেরা বহু দিন নিজস্ব প্রতিভায় উজ্জ্বল, বাংলাদেশি মহিলা পরিচালক শবনমও তাই?
পরমব্রত: মুম্বইয়ের অনভিতা দত্ত ছাড়া বাকি ভারতীয় মহিলা পরিচালকদের সঙ্গে কাজের সৌভাগ্য হয়নি। অনভিতা অন্য মার্গের লেখক-পরিচালক। তাই কোনও তুলনায় যাব না। শবনমের এটা প্রথম বড় ছবি। উনি সাংবাদিক। বেশ কিছু প্রামাণ্য তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। খুবই প্যাশন নিয়ে প্রথম ছবিটি বানিয়েছেন। ফলে, শবনম সব জানেন বা সব কিছু জেনে পরিচালনায় হাত রেখেছেন তেমন নয়। তবে ওঁর ভাবনার প্রশংসা করতেই হয়। এক রক স্টারের বিচিত্র যাত্রাপথের গল্প ক্যামেরাবন্দি করেছেন। যে গল্প বাংলাদেশের বিপুল গানভাণ্ডারকেও ছুঁয়ে গিয়েছে। শবনম এই দিক থেকে অনেকটা নম্বর পাবেন। আমি শেষ পর্যন্ত ছবিটি দেখেছি। সমস্ত মিলিয়ে দর্শকদের মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই ‘আজব কারখানা’।
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং রুদ্রনীল ঘোষ।
প্রশ্ন: শ্যুট করতে করতে আপনার পরামর্শ বা সাহায্য নিয়েছেন শবনম?
পরমব্রত: (হাসি)নিজে পরিচালক বলে আমি নিজেই পরামর্শ দিয়ে থাকি। এই ছবির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে খুব অভিজ্ঞ পরিচালক হলে পরামর্শ দেওয়া থেকে নিজেকে সামলেই রাখি। তখন আমি শুধুই অভিনেতা। তার থেকে মত বিনিময় এবং কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্যও হয়েছে বা হয়। এখানেও সেটা হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি তো তা হলে কলকাতার ‘মি. পারফেকশনিস্ট’! আমির খানের মতো...
পরমব্রত: কলকাতায় বসে ‘মি. পারফেকশনিস্ট’ হওয়ার মতো বিলাসিতার কোনও সুযোগই নেই (হাসি)। বিদেশে বা বলিউডে বছরে একটি কাজ করলে যে উপার্জন সম্ভব। সেটা এখানে অনেক সময়েই সম্ভব নয়। ফলে, জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে গিয়ে সাধারণত একাধিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। পরিমাণে অনেক কাজ করতে হয়। টলিউডে সেটা সম্ভব হলে আমিও সেটাই করতাম। বছরে একটা ছবি হয়তো করতাম। তবে অনেক কাজের মধ্যেও কাজের প্রতি সুবিচারের চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: বাংলা-বলিউড-বাংলাদেশের সব মাধ্যমেই আপনি। রাজ্য রাজনীতিতেও আছেন, সামলাচ্ছেন কী করে?
পরমব্রত: রাজ্য-রাজনীতিতে আমি কিন্তু একেবারেই সক্রিয় নই। কোনও দিনই সক্রিয় রাজনীতি করিনি, করি না, করবও না। আমার কিছু বাছ-বিচার আছ। সে সব নিয়ে আমার কোনও রাখঢাক নেই। সেটুকুই আমার রাজনীতি-যোগ। এর বাইরে রাজনীতিতে কোনও যোগ নেই। যোগ দেওয়ার মতো সত্যিই সময়ও নেই।
প্রশ্ন: নিন্দকেরা যে বলেন বন্ধু রুদ্রনীল ঘোষের মতোই পরমব্রতও নাকি ‘দলবদলু’, ‘গিরগিটি’!
পরমব্রত: আবারও বলছি, আমি কোনও দিন কোনও রাজনৈতিক দল করিনি, করি না। আগামী দিনেও কোনও পরিকল্পনা নেই। না করেও আমি অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সমালোচক। সে জায়গা থেকে, বর্তমানে দেশে যে দলকে আমার বিজেপি, আরএসএস-এর বিরুদ্ধে সব থেকে বড় বিরোধী শক্তি বলে মনে হবে আমি তাদের দিকে একটু ঝুঁকেই থাকব। সেটা যে কোন দল হতে পারে। নির্বাচন এর আগেও তাই থেকেছি এখনও তাই আছি। প্রথমে সিপিআই (এম), পরে তৃণমূল, তার পর বিজেপি, তার পর আবারও শাসকদলে, এটা আমাকে অন্তত করতে দেখা যায়নি। আশা করি, এটা আনন্দবাজার অনলাইনও মানবে। ভবিষ্যতেও যাব না। কাজেই, এ ব্যাপারে আমার কিছু সহকর্মীর সঙ্গে আমার তুলনাটা সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু সংবাদমাধ্যমের তৈরি সাময়িক মজা পাওয়ার জন্য একটি ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ট্রোলিং এই মুহুর্তে একটি আন্তর্জাতিক অবসেশন! সেটা করতে কার্যকারণ, জ্ঞান, যুক্তিবোধ কিচ্ছু লাগে না। তাই ও সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমার কিছু সহকর্মীর মতো রাজনীতি আমার পেশা নয়। আমার রাজনীতিবোধ আমার চেতনায়। ব্যস সে টুকুই। নিজেকে বাম-মনস্ক আগেও বলতাম। আজও বলব। তার মানে সেটা সিপিএম করা নয়। প্রচুর বাম সংগঠন আছে যারা সিপিআইএম নয়।
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন:রাজনীতি একদা কাছের বন্ধু রুদ্রনীলের থেকে দূরত্ব তৈরি করেছে। সেই ফাঁক ভরাট হবে?
পরমব্রত: আমাদের মধ্যে সৌজন্য এখনও অটুট। দেখা হলে শরীর-স্বাস্থ্য, বাড়ি, কাজকম্মো নিয়ে দিব্য কথা হয়। প্রয়োজনে হয়তো কাজও করব। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মনের দিক থেকে যে আত্মীয়তা ছিল সেটি আর নেই। হবেও না। কারণ, বিজেপি বা অতি দক্ষিণপন্থীর সঙ্গে কিছুতেই আমি গলায় গলায় বন্ধুত্ব করতে পারব না। সেটা ১৯৪০ সালে জন্মালেও একই হত। এই দিক থেকে আমি এক বগ্গা। আর রুদ্রনীলের সঙ্গে মানসিক দিক থেকে এই ভাঙন কিন্তু ২০১২ থেকে শুরু। ২০২১-এ এসে নতুন করে কিছু হয়নি।
প্রশ্ন: আপনার ব্যক্তি জীবন নিয়েও নিন্দকদের দুর্নাম, আপনি নাকি একাধিক সংসার ভেঙেছেন!
পরমব্রত: এই নিয়ে কোনও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেই কোনও কথা বলব না।