অপরাজিতা
নিজেকে বলেন টেলিভিশনের ‘স্বর্ণযুগের’ মানুষ। পঁচিশ বছরের কেরিয়ারে উনিশ বছর ভরিয়ে দিয়েছে ছোট পর্দা। সেই মাধ্যমের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য এখন কনটেন্টভিত্তিক ছবির মুখ। গত বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর ছবি ‘চিনি’ সিনেমা হলে দর্শক ফিরিয়েছিল। মৈনাক ভৌমিকের আগামী ‘একান্নবর্তী’ ছবিতে তিনি মলাট চরিত্রে।
পরিচালকের সঙ্গে চতুর্থ বার জুটি বেঁধে উচ্ছ্বসিত অভিনেত্রী। ‘‘মৈনাক যখন ‘ঘরে অ্যান্ড বাইরে’ ছবিটা করছিল, তখন আমাকে একদিন দেখা করতে বলে। রিপড জিনস আর টি শার্টে দেখে ও খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি এরকম পোশাক পরো?’ বলেছিলাম, লোকে এই পোশাকে আমাকে মানতে পারে না বলে ছবি হয়তো কম দিই। তবে এ ধরনের পোশাকই পরি আমি,’’ নাগাড়ে কথাগুলো বললেন অপরাজিতা। ‘ঘরে অ্যান্ড বাইরে’, ‘জেনারেশন আমি’, ‘চিনি’... মৈনাকের সঙ্গে পরপর কাজ করার পরে, তাঁর নির্দেশনায় আরও একটি ছবি করতে প্রথমে সঙ্কোচ ছিল অপরাজিতার। বাদ সেধেছিল অতিমারি।
‘‘আমার শ্বশুরমশাই এবং তারও আগে পরিবারের বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। মানসিক ভাবে তৈরি ছিলাম না ছবিটা করার জন্য। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে কাছের মানুষদের হাসপাতালে ভর্তি করানো, কমিউনিটি কিচেনের দায়িত্ব নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, ভুলেই গিয়েছিলাম অভিনয় করি। মৈনাককে বলেওছিলাম, অন্য কাউকে নিয়ে নিতে। তবে ও রাজি ছিল না। লুক সেট, মহরত শট বাদ রেখে সরাসরি শুটিংয়ে গিয়েছিলাম। এই ছবি দেখে দর্শকের যেন ‘চিনি’র মিষ্টির কথা মনে না পড়ে, সেটা মাথায় রেখেছিলাম,’’ বললেন অপরাজিতা। ‘একান্নবর্তী’তে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সৌরসেনী মৈত্র, অলকানন্দা রায় প্রমুখ।
বরাবর মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে টাইপকাস্ট হয়ে যান না অপরাজিতা? ‘‘চরিত্র এক ধাঁচের হলেও, নিজেকে ভাঙার চেষ্টা করি। তাই টাইপকাস্ট হওয়ার ভয় নেই। আমার যখন তেইশ বছর বয়স ছিল, তখন থেকেই মায়ের চরিত্র করছি। ‘এক আকাশের নীচে’তেও মা হয়েছিলাম। আসলে আমার সব চরিত্রে মা-সুলভ ব্যাপার থাকে। অনেকে বলেন, ‘অপাদি, তোমাকে দেখে যেন মাকে খুঁজে পেলাম!’ আমাকে দেখে মানুষের মন খুশি হয়ে যায়।’’ নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করতে আপত্তি রয়েছে অপরাজিতার।
ছবির কাজে ব্যস্ত থাকলেও, ছোট পর্দায় ফিরতে চান অভিনেত্রী। ‘‘আমার মা-ই হলে গিয়ে ছবি দেখতে পারেন না। আর মা-মাসিরা তো আমার বিশাল ফ্যান। বালুরঘাট, মেদিনীপুরে অনুষ্ঠান করতে গেলে ওখানকার মানুষ বলেন, ‘দিদি, আপনার সিরিয়াল প্রজেক্টরে চালিয়ে দেখি।’ ছোট পর্দায় অভিনয় মিস করছি,’’ বললেন অভিনেত্রী।
ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দার জার্নি সম্পর্কে অপরাজিতার পর্যবেক্ষণ স্পষ্ট। ‘‘আমি যে সময়ে টেলিভিশনে কাজ করতাম, তখন ঋতুপর্ণ ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অতনু ঘোষ, অঞ্জন দত্তের মতো পরিচালকেরা কাজ করতেন। সূক্ষ্মবোধের এমন সব টেলিফিল্ম তৈরি হয়েছে ওই সময়ে, তেমন ছবিও এখন হয় না! তখন কমার্শিয়াল ছবি মানেই মারপিট, ঝাউবনে নাচ... টিভির কাজে এত সন্তুষ্ট ছিলাম যে, ছবিতে আকৃষ্ট হতাম না।’’ কিন্তু অভিনেত্রীর মতে, টেলিভিশন ও ছবির ধারা এখন বদলে গিয়েছে। ‘‘টিভিতে এক ধরনের সাজগোজ, দেখানোর ভঙ্গি রয়েছে। বড় পর্দায় চলছে কনটেন্ট। ‘বেলাশেষে’ থেকে সে ট্রেন্ডের শুরু।’’
মাধ্যমের চাহিদা মেনে অভিনয়ের ধারা বদলায়, মত অপরাজিতার। ‘‘এখন টেলিভিশন কেউ সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে দেখেন না। কেউ খারাপ ব্যবহার করলেও তাকে হয়তো কথা শোনানো হয়নি। টিভির পর্দায় যখন কোনও চরিত্র পাল্টা উত্তর দেয়, তখন তা দেখেই আনন্দ পান দর্শক। টিভিতে তাই চড়া দাগের অভিনয় করতে হয়। তবে বড় পর্দায় ‘বিহেভ’ করতে হয়,’’ বললেন তিনি।
অপরাজিতার হাতে রয়েছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়ের ‘বেলাশুরু’, পাভেলের ‘কলকাতা চলন্তিকা’, ‘মনখারাপ’, প্রেমেন্দুবিকাশ চাকীর ‘লাভ ম্যারেজ’। ‘‘পাভেলের ‘কলকাতা চলন্তিকা’য় চরিত্রটা বিবাহিত নয়। কিন্তু তার মধ্যেও মা রয়েছে,’’ বললেন অভিনেত্রী।
অতিমারির প্রথম পর্যায়ে তিনি বাড়িতে বেশ ভাল ছিলেন। ‘‘চব্বিশ বছরের দাম্পত্যে আমি যখন ফিরতাম, তখন বর ঘুমিয়ে থাকত। বর যখন ফিরত, তখন আমি ঘুমোতাম। দশ বছর এ ভাবেই কেটেছে। এত ছুটি এই প্রথম পেলাম,’’ হাসির দমক তাঁর কণ্ঠে। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছিল তাঁকে। ঘুমের ওষুধও খেতে হয়েছিল।
অপরাজিতার হাসিমুখে ভরসা রাখেন অনুরাগীরা। শিল্পীর চলার পথের সম্বল সে অকৃত্রিম ভালবাসা।