শহরের মানুষজনের সঙ্গে এখন দেবদীপের আলাপ বেশ জমে উঠেছে।
গানের সঙ্গে তাঁর আলাপ বহুদিনের। শহরের সঙ্গে আরও অনেক বছর আগের। খালি শহরের লোকগুলোর সঙ্গেই ‘হয়নি আলাপ’। কারণ, মাঝে তেঁতুল বনে হারিয়ে গিয়েছিলেন। আর যখন ফিরলেন, তখন আলোর থেকেও জোরে ছুটে ফিরলেন। তার চেয়েও বেশি জোরে ছুটল তাঁর গান...‘হয়নি আলাপ’।
চলতি বছরের ৯ এপ্রিল গানটি আপলোড করা হয় ইউটিউবে। তার ঠিক হাতে গোনা ৭ দিনের মাথায় ১ লক্ষ ভিউয়ার ছাড়িয়ে গিয়েছে ইউটিউবে। যদিও গানটি দেবদীপ গেয়েছিলেন বর্ষবরণের রাতে একটি রুফ কনসার্টে। যে কনসার্টের আয়োজক ‘চন্দ্রবিন্দু’র গায়ক উপল সেনগুপ্ত।
গানটি দেবদীপ কম্পোজ করেছিলেন ২০১৫ সালে। আস্তে আস্তে যে তিনি সেলেবহচ্ছেন, তা ভালই বুঝতে পারছেন গায়ক। কেননা আজকাল রাস্তায় লোকজন তাঁকে দেখলেই ‘হাই দেবদীপ! আমি না তোমার ফ্যান হয়ে গিয়েছি’ বলে বসছেন। কিন্তু, এ সবে তিনি বয়ে যেতে চান না। বলছেন,‘‘ভাল গেয়েছি, ভাল লেগেছে। খারাপ করলে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিতে কারও এক মিনিট সময় লাগবে না।’’
আড্ডা চলছিল বাগবাজার ঘাটে। রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান, তাসের আড্ডার পাশের ফাঁকা জায়গাটাতেই গল্প শুরু করে দিলেন। পাশে বেশ কয়েকজন একটু গালমন্দ করেই নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। থামিয়ে দিলেন দেবদীপ। বললেন,‘‘দাদা একটা ইন্টারভিউ হচ্ছে। একটু আস্তে প্লিজ!’’
গানের সঙ্গে আলাপ:
সেই ক্লাস থ্রিতে। আমার কাকার একটা ডেক ছিল। তাতে ‘মোহরা’ ছবির গানগুলো বাজত। আমি শুনতাম। হেব্বি নাচতাম। আর কখনও কখনও গুনগুনও করতাম। কিন্তু মা-বাবা বরাবরই রবীন্দ্রসঙ্গীত, মান্না দে, কিশোর কুমার— এঁদের গান শুনতেন। কিন্তু, ওই গানগুলো তখন আমার খুব কঠিন মনে হত। মা মাঝে বেশ কয়েকবার হারমোনিয়াম নিয়ে বসানোর চেষ্টা করেছিল। আমার ঘুম পেয়ে যেত। ক্লাস সেভেনে একদিন দেখি নব্যেন্দু (প্রিয় বন্ধু) বেঞ্চ বাজিয়ে গাইছে ‘জোনাকিটা জ্বলছিল মিটিমিটি সন্ধের কাঁচা আঁধারে।’ অদ্ভুত লেগেছিল গানটা। এত সিম্পল কথা, গানও হতে পারে! সে দিন থেকেই শিলুদার(শিলাজিৎ মজুমদার) ডাই-হার্ট ফ্যান।
আরও পড়ুন, ‘কাস্টিং কাউচের শিকার হতে যাচ্ছিলাম আমিও’
শিলাজিতের শো:
ক্লাস নাইনে প্রথম দেখি শ্যাম পার্কে। তার পর থেকে ব্যাপারটা এরকম হয়ে গিয়েছিল যে, শিলুদার শো মানে আমি সেখানে যাবই। আমার মন্টি কার্লোর টি শার্ট ছিল একটা। শিলুদা ওটায় সই করে দিয়েছিল। আর এখন ওঁর সঙ্গেই স্টেজ শেয়ার করি। ভাল লাগে, খুব ভাল লাগে। শিলুদা যদি না কোনও দিন বাদ দেয়, ওর সঙ্গেই গান গেয়ে যেতে চাই।
ফার্স্ট অ্যালবাম:
‘স্বপ্ন রঙের মেয়েটা’ আমার ফার্স্ট বেসিক অ্যালবাম। ২০১৪ সালে রিলিজ করেছিল। আর সেই অ্যালবামের আদ্যোপান্তই আমার নিজের হাতে তৈরি করা। সিডিগুলো আমি নিজে বার্ন করেছি, এক দাদা কভারের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন, স্টিকারগুলো সিডিতে নিজে লাগাতাম। তার পর নিজের হাতে করে মানুষজনের কাছে সিডি পৌঁছে দিয়েছি। পরে শ্রীনিবাস মিউজিক অ্যালবামটা রিলিজ করে।
কিন্তু, সেই অ্যালবাম রিলিজ করতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। এক নামজাদা মিউজিক কোম্পানির কাছে গিয়েছিলাম অ্যালবাম রিলিজের জন্য কথা বলতে। সেই কোম্পানির মালিক আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘তোমার বড় বড় চুল দাড়ি, হিপি লুক। নেশাভান নিশ্চয়ই করো। ভরসা পাচ্ছি না।’’ আমি তাঁর কাছে আমার গান নিয়ে গিয়েছিলাম, কত খরচা হতে পারে সেটা জানতে। আমাকে না চিনেই, অপরিচিত একটা লোক যে কী করে এমন কথা বলতে পারেন, ধারণার বাইরে। বেরিয়ে চলে আসি আর রিলিজের দায়িত্ব নিজেই নিই। তবে ‘স্বপ্ন রঙের মেয়েটা’ ইউটিউবে ১ হাজার ভিউয়ার করতে গিয়েই কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
‘হয়নি আলাপ’:
বিরাট ঝড় উঠেছিল সে দিন। আমি তখন রাস্তায়। রবীন্দ্র সদন অবধি পৌঁছেছিলাম। কিন্তু যেখানে যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারিনি। কিছুদূর গিয়ে বাইকটা ঘোরাই। ওহ বাবা! ফেরার সময় দেখি গোটা ধর্মতলা জুড়ে বিরাট জ্যাম। বাইক নিয়ে নড়াচড়ার বিন্দুমাত্র জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। ঝড়ে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার পাঁপড়িগুলো দেখি আমার মাথার উপর ঝরে পড়ছে। যেই না জ্যামটা একটু কমতে শুরু করল, ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
চাঁদনি চক ছাড়িয়েছি আর একটা ফোন। ততক্ষণেআমি কাকভেজা। উপলদা ফোনের ওপারে। জানালেন, ‘হয়নি আলাপ’-এর ১ লক্ষ ভিউয়ার! ৯ এপ্রিল ভিডিয়োটা ইউটিউবে আপলোড করেছিলাম, আর ১৭ এপ্রিল ১ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দিনটা চিরকাল মনে থাকবে, আমার মনেও ঝড় উঠেছিল সে দিন।
গানের গুরু:
আমার গানের শিক্ষা অনেক পরে। টুয়েলভ পাশ করেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত নিয়ে ভর্তি হই। সরোদ শিখেছি ওখানেই। গিটারতো নিজে নিজেই শিখেছি। তবে গানে আমার প্রথম স্কুলিং শিলুদার বাড়িতে। একবার মনে আছে, হেব্বি মার খেয়েছিলাম শিলুদার হাতে। ও তখন পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে থাকত। ‘যা পাখি...’ গানটার সুরই ভুলিয়ে দিয়েছিলাম শিলুদাকে। মানে... আমি তো প্রতিভা, গায়ককে তাঁর গানের সুরই ভুলিয়ে দিচ্ছি। হেব্বি ঝাড় খেয়েছিলাম, মারও। আজ বুঝতে পারি, ওই বকুনিগুলোই এতদিন প্রোটিনের মতো কাজ করেছে।
বাইক দেবদীপের সর্বক্ষণের সঙ্গী।
কভার:
‘হয়নি আলাপ’ অনেকেই কভার করেছে। কিন্তু আমার খুব বিরক্ত লাগত। একজনের সঙ্গে তো খুব ঝামেলাও করেছিলাম। পরে মনে হল, আমার গান কভার করছে, আমিও তো একদিন কারও গান কভার করতাম। কত জন হয়তো আমার অজান্তেই রোজ বাথরুমে গেয়ে চলেছে,‘হয়নি আলাপ’। আমার তো খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু অনেকেই আছেন, আমার ভয়েসটা রেখে সেই জায়গায় অন্য একটা ভিডিয়ো দিয়ে নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে চালান। সেটা খুব খারাপ, দুর্ভাগ্যজনক। আমাদেরকেও অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে গান তৈরি করতে হয়। এত সহজ নয় ব্যাপারটা।
নতুন কিছু:
নতুন বেশ কয়েকটা গান রেডি। সেগুলো করব এক এক করে। শিলুদা ঠিক করেছে,‘হয়নি আলাপ’-এর একটা রিমিক্স ভার্সন তৈরি করবে। শিলুদা নিজেই প্রোডিউস করবে ওই ভার্সনটা। আমাকে অনেক দিন ধরেই তাড়া দিচ্ছে, হয়ে উঠছে না। জানি এ বার ঝাড়টা খাব। একটা সিনেমায় গান গাওয়ার কথা হচ্ছে। সেটা একটা টপ্পা হবে। আমিই তৈরি করছি। আর একটা শর্ট ফিল্মে গান গাইলাম রিসেন্টলি। সামনের বছর বাইক নিয়ে লাদাখ যাব ঠিক করেছি। ওখানকার অ্যাম্বিয়েন্সে, ওখানকার মানুষজনদের নিয়ে গান রেকর্ড করব ঠিক করেছি।
আরও পড়ুন, ‘আমার মা কে সাধ খাইয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর’
নিজের গানের ভাষার সঙ্গে আলাপ:
ফুল-পাখি-তারা, হলদে জল— এসব নিয়ে একসময়ে অনেক গান লিখেছিলাম। পরে মনে হয়েছিল এই ট্র্যাশগুলো এবার লেখা বন্ধ করতে হবে। আমি তোমাকে ভালবাসি, এই কথাটা আর বলা যাবে না। আমাকে অন্য কিছু বলতে হবে। কারণ, রোজ ভাত-ডালই চলতে পারে, বিরিয়ানি নয়।
তাই যত সহজ গানের ভাষা হবে, তত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারব। আমাদের রোজকার কথা বলার ভাষাই তো কত বদলাচ্ছে। গানের কথার বদলটাও খুব স্বাভাবিক। এ নিয়ে আমার এক বান্ধবী রিসার্চও করছে। ওঁর রিসার্চ পেপারে আমারই একটা গানের উল্লেখ করেছে। গানটা লেখা আমার, সাইড দেবেন প্লিজ। গেয়েছিল এক বন্ধু।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক:
আমার বিশ্বাস, আমার গান শুনে আরও অনেকে সাহস পাবে নতুন গান লিখতে, সুর দিতে, গাইতে। এ ভাবেই দিনের পর দিন নতুন গান তৈরি হয়েছে। আগামী দিনেও তাই হবে। আমাকে অনেকেই বলছেন, তাঁরা আমার সঙ্গে গান গাইতে চায়। তবে আমার সাধ্য মতো যতটা সম্ভব আমি নতুনদের সাহায্য করব। কিন্তু বাকিটা তাঁদের নিজেদেরই করে নিতে হবে। কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার নেই।
পাশাপাশি দুটো গাছ কিন্তু একে অপরকে বলে না যে, ‘‘এই আমাকে একটু বড় হতে সাহায্য কর তো।’’ ভাল গান হচ্ছে, হবে। আর সেই ভাল গান হিটও হবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না। আর তাতেই রুজি-রোজগারও হবে। ফুল ফুটবেই। কেউ যদি এখন এসে বলে,‘ও ফুল ফুটো না গো!’ তাতে ফুলের কিস্যু যায় আসে না।
সিম্প্লিসিটি তাঁর গানের একটা পন্থা বলছিলেন দেবদীপ।
একা নাকি দোকা:
সম্পর্কে আছি। তার মানে এই নয় যে কখনও আর কারও সঙ্গে প্রেম হবে না। আমারই তো গান আছে ‘কোথাও তো লেখা নেই, তোমাকে আমার হতে হবে...’
ফিমেল ফ্যান:
জানি, তাদের জন্যই আমার গান বেশি হিট হয়েছে। এত ভিউয়ারের মধ্যে তাদের সংখ্যাটাই বেশি। একটা যদি মেশিন থাকত যাতে সব্বাইকে বলা যেত যে, আমি তাদের কতটা ভালবাসি, বলে দিতাম। তাদের বলব, আরও ভালবাসো, রাগ করো, অভিমান করো, রিজেক্ট করো, কেউ ছল করলে তাঁর সঙ্গে ছলই করো, খালি ঝুলিও না।
প্রাক্তন:
সিনেমাটা দেখেছি। গানগুলোও শুনেছি। খুব ভাল। আমার বেসিকালি প্রাক্তনদের কিছুই বলার নেই। আর নেই বলেই তাঁরা প্রাক্তন। যে কোনও কারণেই কথা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা খুব পীড়াদায়ক। সম্পর্কের ফাটলটা সেখান থেকেই ধরে।
আরও পড়ুন, এই সুপার হিট সিনেমাগুলোর অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কাজল!
আর ইমন:
সম্পর্ক ছিল এক সময়ে, আর এখন বন্ধু। এখনও কথা হয়। আড্ডা হয়। এক সময় ওঁর বা আমার কারও পোষায়নি বলে আজ বন্ধুত্বটা নষ্ট করে দেব বা দেখলেই তিতিবিরক্ত হব, এমনটা নয়। সম্পর্কে যখন বনিবনা হয় না, তখন আর একসঙ্গে থেকে বিরক্তি বাড়ানো উচিত নয়। বরং দূর থেকে বন্ধুত্বটা টিকিয়ে রাখা উচিত।
সেরা প্রাপ্তি:
এই যে এত ভিউয়ার হয়েছে, এ কিছু কম প্রাপ্তি নয়। একদিন ফেসবুক মেসেঞ্জারে দেখি ক্যালিফোর্নিয়ার এক প্রবাসী বাঙালি একটি ভিডিয়ো পাঠিয়েছেন। ছোট্ট নীল নীল চোখের বাচ্চাটা গাইছে,‘আ লা লা লা লা লা লা...’। রাজর্ষি গুহ গুগ্লে চাকরি করেন, তাঁর ছোট্ট মেয়ে। কুয়েত থেকেও একটি বাচ্চা মেয়ে ‘হয়নি আলাপ’ পিয়ানোতে কভার করেছিল। আমাকে পাঠিয়েও ছিল। তবে রোজ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আর সকালে উঠেই, ইউটিউবে কতজন ভিউয়ার বাড়ল বাবা এক বার করে চেক করে। চেক করেই আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে।