আনন্দ যখন মজে কুইন্স গ্যাম্বিটে। ফাইল চিত্র।
এক সিরিজেই কিস্তিমাত!
নেটফ্লিক্সে অনাথ বিস্ময়কন্যা দাবাড়ুর জীবন নির্ভর সিরিজ ‘দ্য কুইন্স গ্যাম্বিট’-এ আপাতত মজে দাবায় পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ। চেন্নাই থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বললেন, ‘‘সদ্য শেষ করলাম সিরিজটা। আমাদের দেশে যে কেন এমন একটা সিরিজ হয় না!’’ দেশের দ্বিতীয় তথা বাংলার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়ার বক্তব্য, ‘‘আনন্দ ঠিকই বলেছে। আমরা এ ভাবে ভাবতেই পারি না। সিরিজটা এক কথায় অনবদ্য।’’
ওয়াল্টার টেভিসের ১৯৮৩ সালের একটি উপন্যাস অবলম্বনে স্কট ফ্র্যাঙ্ক এবং অ্যালান স্কট সিরিজটি তৈরি করেছেন। নেটফ্লিক্সে যা ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় বিশ্বজুড়ে। সিরিজটি তৈরির সময় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক। দাবাড়ুরা জানেন, ‘কুইন্স গ্যাম্বিট’ হল দাবার একটি বিশেষ ওপেনিং। দিব্যেন্দু বলছেন, ‘‘চৌষট্টি খোপে নিজের জায়গা মজবুত করতে এই ওপেনিংয়ে শুরুতেই একজন দাবাড়ু একটি ঘুঁটি (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বোড়ে) খোয়ান। দাবার পরিভাষা ধার করে বললে, মূলত ‘স্থানগত সুবিধা’ (স্পেস অ্যাডভান্টেজ), ‘অগ্রগতির সুবিধা’ (ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভান্টেজ) আর ‘ইনিশিয়েটিভ’— এই তিনটে সুবিধা পাওয়া যায়।’’
যে ভাবে ‘দ্য কুইন্স গ্যাম্বিট’-এর পরিচালক সিরিজ তৈরির খুঁটিনাটি নিয়ে কাসপারভের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, ভারতের কোনও পরিচালক যদি এমন কোনও সিরিজ তৈরির সময় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন? আনন্দের উত্তর, ‘‘অবশ্যই সাহায্য করব। খুব খুশি হব কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে।’’ সঙ্গে সংযোজন, ‘‘সবক’টা এপিসোড দেখেছি। খুব ভাল লেগেছে। যে ভাবে খুদে বিস্ময়কন্যার চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা আমায় মুগ্ধ করেছে। যে রকম নিখুঁত ভাবে দাবার বোর্ডে সাজানো হয়েছে বারংবার, তাতে কোনও ত্রুটি খুঁজে পাইনি। অনেক সময়ই ফিল্মে যখন কোনও দৃশ্যে দাবা খেলা দেখানো হয়, তখন খুব বেশি বোর্ডের ছবি সেখানে জায়গা পায় না। এখানে স্পষ্ট সেটা বোঝা যায়। সেই সঙ্গে গল্পটা যে ভাবে এগিয়েছে, তা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়েছে।’’ প্রসঙ্গত, বর্তমান বিশ্বজয়ী বিস্ময়প্রতিভা সম্পন্ন দাবাড়ু ম্যাগনাস কার্লসেন রবিবার ‘দ্য কুইন্স গ্যাম্বিট’-এর রেটিং করতে গিয়ে ৬-এ ৫ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ‘কুইন্স গ্যাম্বিট’ বা ‘রানির প্যাঁচ’ নামটি নিয়েই নিজের উপন্যাসের নাম দিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক টেভিস। তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য বেথ হার্মন নামে এক অনাথ শিশুর বিশ্বের সেরা দাবাড়ু হয়ে ওঠার কাহিনি। যে মেয়ে সাফল্য পাওয়ার পথে নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে এগোয়। কখনও মাদকাসক্তি, কখনও মদ্যপানের প্রতি আসক্তি তার এগোনোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকে সে। ছোটবেলায় গাড়ি দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যুর পরই এক হোমে স্থান হয় ন’বছরের বেথের। সেখানেই প্রথম চৌষট্টি খোপের এই খেলার সঙ্গে পরিচয়। অতঃপর তাকে দত্তক নেয় স্থানীয় এক দম্পতি। সে সময়ই তার জীবনে প্রথম একটি টুর্নামেন্ট খেলার অভিজ্ঞতা হয়। পালক মা-ও তার সঙ্গে এর পর নানা ‘মিট’-এ যেতে থাকেন। যা দেখে দিব্যেন্দু বলছেন, ‘‘পরিবারের সাহায্য ছাড়া এগোন যায় না। সিরিজটা দেখতে গিয়ে মনে পড়ছিল ছোটবেলায় দেখেছি, আনন্দ যেখানে যেত, ওর মা সঙ্গে যেতেন।’’
এমন একটা সিরিজ আমরা কেন ভাবতে পারি না— প্রশ্ন দিব্যেন্দু বড়ুয়ার।
‘দ্য কুইন্স গ্যাম্বিট’-এর গল্প নিজের ছন্দে এগিয়েছে। একটির পর একটি মিটে জয়ী হতে থাকে কিশোরী বেথ। বহু মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এক সময় আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বেথ বুঝতে পারে, তখনও তার জীবনে অনেক কিছু অর্জন করা বাকি। বিশেষ করে রুশ দাবাড়ুদের সঙ্গে টক্কর। শেষমেশ মস্কোয় এক রুশ বিশ্বজয়ীকে একটি ম্যাচে হারায় বেথ। সেই ম্যাচটির সূচনা ‘কুইন্স গ্যাম্বিট’ ওপেনিং দিয়েই করেছিল বেথ।
আনন্দ বলছেন, ‘‘যে সময়ের গল্প এটা, তখন দাবা মূলত ছিল ছেলেদের খেলা। সেখানে একটি মেয়ের সেরা হয়ে ওঠার গল্প খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে। তবে শুধু একটা চরিত্র নিয়ে তো কোনও সিরিজ হয় না। ফলে বেথের পাশে অন্য চরিত্রগুলোও অসাধারণ। এমন সিরিজ সত্যিই কখনও দেখিনি। সদ্য ইন্সটাগ্রামে এক ভিডিয়োতে এটা বলেওছি।’’
ওই যে, এক সিরিজে আনন্দও কিস্তিমাত।